পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (পঞ্চম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬৪১

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

VeS8 রবীন্দ্র-রচনাবলী আবশ্যক নাই ; অধীন ভারতবর্ষেও দেখা যাইতেছে, ইংরাজের সহিত ইংরাজি, শিক্ষিতদের ক্রমশই একটি অ-বনিবনাও হইয়া আসিতেছে । তিলমাত্র অবসর পাইলে কেহ কহাকেও ছাড়িতে চায় না । ইটটির পরিবর্তে পাটকেলটি চলিতেছেই । আমরা যে-সকল জায়গায় সুবিচারপূর্বক পাটকেল নিক্ষেপ করি তাহা নহে, অধিকাংশ স্থলে অন্ধকারেই ঢ়েলা মারি । আমাদের কাগজে পত্রে অনেক সময় আমরা অন্যায় খিটিমিটি করিয়া থাকি এবং অমূলক কেন্দল উত্থাপন করি, সে কথা অস্বীকার করা যায় না। কিন্তু সেগুলিকে স্বতন্ত্রভাবে বিচার করিবার আবশ্যক নাই । তাহার কোনোটা সত্য কোনোটা মিথ্যা, কোনোটা ন্যায় কোনোটা অন্যায় হইতে পারে ; আসল বিচাৰ্য বিষয় এই যে, আজকাল এইরূপ পাটকেল ছুড়িবার প্রবৃত্তিটা এত প্রবল হইয়া উঠিতেছে কেন । শাসনকর্তা খবরের কাগজের কোনো-একটা প্ৰবন্ধবিশেষকে মিথ্যা সাব্যস্ত করিয়া সম্পাদককে এবং হতভাগ্য মুদ্রাকরকে পর্যন্ত জেলে দিতে পারে, কিন্তু প্ৰতিদিনই ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের পথে এই যে-সমস্ত ছোটো ছোটো কঁাটােগাছগুলি এই কাটাগাছগুলির মূল যখন মনের মধ্যে তখন ইহাকে উৎপাটন করিতে হইলে সেই মনের মধ্যে প্ৰবেশ করিতে হইবে । কিন্তু পাকা রাস্তা ও কাচা রাস্তা -যোগে ইংরাজরাজের আর সর্বত্রই গতিবিধি আছে, কেবল দুৰ্ভাগ্যক্রমে সেই মনের মধ্যেই নাই। হয়তো সে জায়গাটাতে প্রবেশ করিতে হইলে ঈষৎ একটুখানি মাথা হেলাইয়া ঢুকিতে হয়, কিন্তু ইংরাজের মেরুদণ্ড কোনােখানেই বাকিতে চায় না। অগত্যা ইংরাজ। আপনাকে এইরূপ বুঝাইতে চেষ্টা করে যে, এই-যে খবরের কাগজে কটুকথা বলিতেছে, সভা হইতেছে, রাজতন্ত্রের অপ্রিয় সমালোচনা চলিতেছে, ইহার সহিত “পীপল”এর কোনো যোগ নাই ; এ কেবল কতকগুলি শিক্ষিত পুতুলনাচওয়ালার বুজরুগিমাত্র । বলে যে, ভিতরে সমস্তই আছে ভালো ; বাহিরে যে একটু-আধটু বিকৃতির চিহ্ন দেখা যাইতেছে সে চতুর লোকে রঙ করিয়া দিয়াছে। তবে তো আর ভিতরে প্রবেশ করিয়া দেখিবার আবশ্যক নাই। কেবল যে চতুর লোকটাকে সন্দেহ করা যায় তাহাকে শাসন করিয়া দিলেই চুকিয়া যায়। ঐটেই ইংরাজের দোষ- সে কিছুতেই ঘরে আসিতে চায় না । কিন্তু দূর হইতে, বাহির হইতে, কোনোক্রমে স্পর্শসংস্রব বঁাচাইয়া মানুষের সহিত কারবার করা যায় না— যে পরিমাণে দূরে থাকা যায় সেই পরিমাণেই নিস্ফলতা প্রাপ্ত হইতে হয়। মানুষ তো জড়যন্ত্র নহে যে তাহাকে বাহির হইতে চিনিয়া লওয়া যাইবে ; এমন-কি, পতিত ভারতবর্ষেরও একটা হৃদয় আছে এবং সে হৃদয়টা সে তাহার জামার আস্তিনে বুলাইয়া রাখে নাই। r জড়পদার্থকেও বিজ্ঞানের সাহায্যে নিগুঢ় রূপে চিনিয়া লইতে হয়, তবেই জড়প্রকৃতির উপর সম্পূর্ণ কর্তৃত্ব বিস্তার করিতে পারা যায়। মনুষ্যলোকে যাহারা স্থায়ী প্রভাব রক্ষা করিতে চাহে তাঁহাদের অন্যান্য অনেক গুণের মধ্যে অন্তরঙ্গরূপে মানুষ-চিনিবার বিশেষ গুণটি থাকা আবশ্যক । মানুষের অত্যন্ত কাছে। যাইবার যে ক্ষমতা সে একটা দুর্লভ ক্ষমতা । ইংরাজের বিস্তর ক্ষমতা আছে, কিন্তু সেইটি নাই। সে বরঞ্চ উপকার করিতে অসম্মত নহে, কিন্তু কিছুতেই কাছে আসিতে চাহে না । কোনোমতে উপকারটা সারিয়া ফেলিয়া আমনি তাড়াতাড়ি সরিতে পারিলে বঁাচে । তাহার পরে সে ক্লাবে গিয়া পেগ খাইয়া বিলিয়ার্ড খেলিয়া অনুগৃহীতদের প্রতি অবজ্ঞাসূচক বিশেষণ প্রয়োগ-পূর্বক তাহাদের বিজাতীয় অস্তিত্ব শরীরমনের নিকট হইতে যথাসাধ্য ইহারা দয়া করে না, উপকার করে ; স্নেহ করে না, রক্ষা করে ; শ্রদ্ধা করে না, অথচ ন্যায়াচরণের চেষ্টা করে ; ভূমিতে জল সেচন করে না, অথচ রাশি রাশি বীজ বপন করিতে কার্পণ্য নাই। কিন্তু তাহার পর যখন যথেষ্ট কৃতজ্ঞতার শস্য উৎপন্ন হয় না। তখন কি কেবলই মাটির দোষ দিবে। এ নিয়ম কি বিশ্বব্যাপী নহে যে, হৃদয়ের সহিত কাজ না করিলে হৃদয়ে তাহার ফল ফলে না । আমাদের দেশের শিক্ষিতসম্প্রদায়ের অনেকেই ইংরাজ-কৃত উপকার যে উপকার নহে। ইহাই