পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (পঞ্চম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬৪৩

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

\9&\e রবীন্দ্র-রচনাবলী ব্যক্তিগত হৃদয়বৃত্তি-দ্বারা অকস্মাৎ বিচলিত না হইয়া কাজের নিয়ম ও সময়ের সুযোগ বুঝিয়া কাজ করা । কিন্তু আমরা সে দিক দিয়া যাই না । আমরা কাজ পাই বা না পাই, কথা একটাও বাদ দিতে পারি না । তাহাতে কেবল যে আমাদের অনভিজ্ঞতা ও অবিবেচনা প্ৰকাশ পায় তাহা নহে, তাহাতে প্ৰকাশ পায় যে, কাজ আদায়ের ইচ্ছার অপেক্ষা দুয়ো দিবার, বাহবা লইবার এবং মনের ঝাল ঝাড়িবার ইচ্ছা! আমাদের বেশি। তাহার একটা সুযোগ পাইলে আমরা এত খুশি হই যে, তাহাতে আসল কাজের কত ক্ষতি হইল তাহা আমরা ভুলিয়া যাই। এবং কটু ভৎসনার পর সংগত প্রার্থনা পূরণ করিতেও গবর্মেন্টের মনে দ্বিধা উপস্থিত হয়, পাছে প্ৰজার স্পর্ধা বাড়িয়া উঠে । ইহার প্রধান কারণ, মনের ভিতরে এমন-একটা অসদ্ভাব জন্মিয়া গিয়াছে এবং প্রতিদিন তীব্রতর হইয়া উঠিতেছে যে, উভয় পক্ষেরই কর্তব্যপালন ক্রমশই কিছু কিছু করিয়া দুরূহ হইতেছে। রাজাপ্রজার এই অহরহ কলহ দেখিতেও কিছুমাত্ৰ ভালো হইতেছে না। গবমেন্টও বাহ্যত যেমনই হউক, মনে মনে যে এ সম্বন্ধে উদাসীন তাহা বিশ্বাস হয় না । কিন্তু উপায় কী । ব্রিটিশ চরিত্র, হাজার হউক, মনুষ্যচরিত্র তো বটে । ভাবিয়া দেখিলে এ সমস্যার মীমাংসা সহজ নহে । সব-প্রথম সংকট বর্ণ লইয়া। শরীরের বর্ণটা যেমন ধুইয়া-মুছিয়া কিছুতেই দূর করা যায় না তেমনি বর্ণসম্বন্ধীয় যে সংস্কার সেটা মন হইতে তাড়ানো বড়ো কঠিন । শ্বেতকায় আর্যগণ কালো রঙটাকে বহু সহস্ৰ বৎসর ধরিয়া ঘূণাচক্ষে দেখিয়া আসিতেছেন । এই অবসরে বেদের ইংরাজি তর্জমা এবং এনসাইক্লোপীডিয়া হইতে এ সম্বন্ধে অধ্যায়, সূত্র এবং পৃষ্ঠাঙ্ক -সমেত উৎকট প্রমাণ আহরণ করিয়া পাঠকদের প্রতি দৌরাত্মা করিতে চাহি না । কথাটা সকলেই বুঝিবেন । শ্বেত-কৃষ্ণে যেন দিনরাত্রির ভেদ । শ্বেতজাতি দিনের ন্যায় সদাজাগ্ৰত, কর্মশীল, অনুসন্ধানতৎপর ; আর কৃষ্ণজাতি রাত্রির ন্যায় নিশ্চেষ্ট, কর্মহীন, স্বপ্নকুহকে আবিষ্ট । এই শ্যামা-প্রকৃতিতে হয়তো রাত্রির মতো একটা গভীরতা, মাধুর্য, স্নিগ্ধ করুণা এবং সুনিবিড় আত্মীয়তার ভাব আছে। দুৰ্ভাগ্যক্রমে ব্যস্ত চঞ্চল শ্বেতাঙ্গের তাহা আবিষ্কার করিবার অবসর নাই এবং তাহার কাছে ইহার যথেষ্ট মূল্যও নাই। তাহাদিগকে এ কথা বলিয়াও কোনো ফল নাই যে, কালো গোরুতেও সাদা দুধ দিয়া থাকে এবং ভিন্ন বর্ণের মধ্যে হৃদয়ের একটা গভীর ঐক্য আছে। কিন্তু কাজ নাই এ-সকল ওরিয়েন্টাল উপমা-তুলনায় । কথাটা এই যে, কালো রঙ দেখিবা মাত্র শ্বেতজাতির মন কিছু বিমুখ না হইয়া থাকিতে পারে না । তার পরে বসনভূষণ-অভ্যাস-আচারে প্রত্যেক বিষয়েই এমন-সকল বৈসাদৃশ্য আছে যাহা হৃদয়কে কেবলই প্ৰতিহত করিতে থাকে । , শরীর অর্ধবৃত রাখিয়াও যে মনের অনেক সদগুণ পোষণ করা যাইতে পারে, মনের গুণগুলা যে ছায়াপ্রিয় শৌখিনজাতীয় উদ্ভিজ্জের মতো নহে, তাহাকে যে জিনবনাতের দ্বারা না মুড়িলেও অন্য উপায়ে রক্ষা করা যায়, সে-সমস্ত তর্ক করা মিথ্যা । ইহা তর্কের কথা নহে, সংস্কারের কথা । এক, নিকট-সংস্রবে। এই সংস্কারের বল কতকটা অভিভূত হইতে পারে। কিন্তু ঐ সংস্কারই আবার নিকটে আসিতে দেয় না। যখন স্টিমার ছিল না এবং আফ্রিকা বেষ্টন করিয়া পালের জাহাজ সুদীর্ঘ কালে ভারতবর্ষ হইতে বিলাতে গিয়া পৌঁছিত তখন ইংরাজ দেশী লোকের সঙ্গে কিছু যেন বেশি ঘনিষ্ঠতা করিত। কিন্তু আজকাল সাহেব তিনটি মাসের ছুটি পাইলেই তৎক্ষণাৎ ইংলন্ডে পলাইয়া গিয়া ভারতবর্ষের সমস্ত ধূলা ধৌত করিয়া আসেন, এবং ভারতবর্ষেও তাঁহাদের আত্মীয়সমাজ ব্যাপক হইয়া পড়িতেছে, এইজন্য যে দেশ তাহারা জয় করিয়াছেন সে দেশে থাকিয়াও যথাসম্ভব না থাকা এবং যে জাতিকে শাসন করিতেছেন সে জাতিকে ভালো না বাসিয়াও কাজ করা সুসাধ্য হইয়া পড়িয়ছে। সহস্ৰ ক্রোশ দূর হইতে সমুদ্র লঙ্ঘন করিয়া আসিয়া একটি সম্পূর্ণ বিদেশী রাজ্য নিতান্ত আপিসের কাজের ন্যায় দিনের বেলায় শাসন করিয়া, সন্ধ্যাবেলায় পুনশ্চ সমুদ্রে খেয়া দিয়া বাড়ি গিয়া তপ্ত ভাত খাওয়া, ইতিহাসে এমন দৃষ্টান্ত আর কোথায় আছে। م.*