পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (পঞ্চম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬৬৬

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

রাজা প্ৰজা V8s ইহাকে নাম দেওয়া যাইতে পারে ‘বিকে মারিয়া বউকে শেখানে রাজনীতি । ঝিকে কিছু অন্যায় করিয়া মারিলেও সে সহ্য করে ; কিন্তু বউ পরের ঘরের মেয়ে, উচিত শাসন উপলক্ষে গায়ে হাত তুলিতে গেলেও বরদাস্ত না করিতেও পারে। অথচ বিচারকার্যটা একেবারে বন্ধ করাও যায় না । যেখানে বাধা স্বল্পতম সেখানে শক্তিপ্রয়োগ করিলে শীঘ্ৰ ফল পাওয়া যায়, এ কথা বিজ্ঞানসম্মত । অতএব হিন্দু মুসলমানের দ্বন্দ্বে শাস্তপ্রকৃতি, ঐক্যবন্ধনহীন, আইন ও বেআইন -সহিষ্ণু হিন্দুকে দমন করিয়া দিলে মীমাংসাটা সহজে হয় । আমরা বলি না যে, গবর্মেন্টের এইরূপ পলিসি ; কিন্তু কাৰ্যবিধি স্বভাবত, এমন-কি, অজ্ঞানত, এই পথ অবলম্বন করিতে পারে- যেমন নদীস্রোত কঠিন মৃত্তিকাকে পাশ কাটাইয়া স্বতই কোমল মৃত্তিকাকে খনন করিয়া চলিয়া যায়। অতএব, হাজার গবর্মেন্টের দোহাই পাড়িতে থাকিলেও গবর্মেন্ট যে ইহার প্রতিকার করিতে পারেন এ কথা আমরা বিশ্বাস করি না। আমরা কনগ্রেসে যোগ দিয়াছি, বিলাতে আন্দোলন করিতেছি, অমৃতবাজারে প্রবন্ধ লিখিতেছি, ভারতবর্ষের উচ্চ হইতে নিম্নাতন ইংরাজকর্মচারীদের কার্য স্বাধীনভাবে সমালোচনা করিতেছি, অনেক সময় তাহাদিগকে অপদস্থ করিতে কৃতকার্য হইতেছি এবং ইংলন্ডবাসী অপক্ষপাতী ইংরাজের সহায়তা লইয়া ভারতীয় কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে অনেক রাজবিধি সংশোধন করিতেও সক্ষম হইয়াছি। এই সকল ব্যবহারে ইংরাজ এতদূর পর্যন্ত জ্বালাতন হইয়া উঠিয়াছে যে, ভারত-রাজতন্ত্রের বড়ো বড়ো ভূধরশিখর হইতেও রাজনীতিসম্মত মীেন ভেদ করিয়া মাঝে মাঝে আগ্নেয় স্রাব উচ্ছসিত হইয়া উঠিতেছে। অপর পক্ষে, মুসলমানগণ রাজভক্তিভরে অবনতপ্রায় হইয়া কনগ্রেসের উদ্দেশ্যপথে বাধাস্বরূপ হইয়া দাড়াইয়াছেন । এই সকল কারণে ইংরাজের মনে একটা বিকার উপস্থিত হইয়াছে— গবর্মেন্টের ইহাতে কোনো হাত নাই । কেবল ইহাই নহে। কনগ্রেস অপেক্ষা গোরক্ষণী সভাটাতে ইংরাজের মনে অধিক আন্দোলন উপস্থিত করিয়াছিল। তাহারা জানেন, ইতিহাসের প্রারম্ভিকাল হইতে যে হিন্দুজাতি আত্মরক্ষার জন্য কখনো একত্র হইতে পারে নাই, চাই-কি গো-রক্ষার জন্য সে জাতি একত্র হইতেও পারে । অতএব, সেই সূত্রে যখন হিন্দু-মুসলমানের বিরোধ আরম্ভ হইল তখন স্বভাবতই মুসলমানের প্রতি ইংরাজের দরদ বাড়িয়া গিয়াছিল। তখন উপস্থিত ক্ষেত্রে কোন পক্ষ অধিক অপরাধী, অথবা উভয় পক্ষ ন্যুনাধিক অপরাধী কি না, তাহা অবিচলিতচিত্তে অপক্ষপাতসহকারে বিচার করিবার ক্ষমতা অতি অল্প ইংরাজের ছিল । তখন তাহারা ভীতচিত্তে একটা রাজনৈতিক সংকট কিরূপে নিবারণ হইতে পারে সেই দিকেই অধিক মনোযোগ দিয়াছিলেন । তৃতীয়-খণ্ড সাধনায় ইংরাজের আতঙ্ক’-নামক প্রবন্ধে আমরা সঁওতাল-দমনের উদাহরণ দিয়া দেখাইয়াছি, ভয় পাইলে সুবিচার করিবার ধৈর্য থাকে না এবং যাহারা জ্ঞানত অথবা অজ্ঞানত ভীতির কারণ তাঁহাদের প্রতি একটা নিষ্ঠুর হিংস্র ভাবের উদয় হয়। এই কারণে, গবর্মেন্ট-নামক যন্ত্রটি যেমনি নিরপেক্ষ থােক। গবর্মেন্টের ছোটােবড়ো যন্ত্রীগুলি যে আদ্যোপােন্ত বিচলিত হইয়া উঠিয়াছিলেন তাহা তাহারা বারংবার অস্বীকার করিলেও লক্ষণে স্পষ্টই প্ৰকাশ পাইয়াছিল, এখনো প্ৰকাশ পাইতেছে । এবং সাধারণ ভারতবষীয় ইংরাজের মনে বিবিধ স্বাভাবিক কারণে একবার এইরূপ বিকার উপস্থিত হইলে তাহার যে ফল সে ফলিতে থাকিবেই- ক্যানটি যেমন সমুদ্রতরঙ্গকে নিয়মিত করিতে পারেন নাই, গবর্মেন্টও সেইরূপ স্বাভাবিক নিয়মকে বাধা দিতে °ोंदिन नां । প্রশ্ন উঠিতে পারে, তবে কেনই-বা বৃথা আন্দোলন করা, এবং আমারই বা এ প্রবন্ধ লিখিতে বসিবার প্রয়োজন কী ছিল । গবর্মেন্টের নিকট সকরুণ অথবা সাভিমান স্বরে আবেদন বা অভিযোগ করিবার জন্য প্ৰবন্ধ লিখার কোনো আবশ্যক নাই, সে কথা আমি সহস্রাবার স্বীকার করি। আমাদের এই প্ৰবন্ধ কেবল আমাদের স্বজাতীয়ের জন্য । আমরা নিজেরা ব্যতীত আমাদের নিজেদের প্রতি অন্যায় ও অবিচারের প্রতিকার কাহারও সাধ্যায়ত্ত নহে। ] ক্যানুটি সমুদ্রতরঙ্গকে যেখানে থামিতে বলিয়াছিলেন সমুদ্রতরঙ্গ সেখানে থামে নাই, সে জড়শক্তির