পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (পঞ্চম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬৬৯

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

VGS রবীন্দ্ৰ-রচনাবলী বদ্ধমূল। এবং যতক্ষণ সে বিশ্বাস আমাদের নিজের মনে নিঃসংশয়ভাবে দৃঢ় থাকে ততক্ষণ আমাদের ভয়ংকারিতাও সর্বতোভাবে দূরীকৃত। কিন্তু অল্পদিনের মধ্যে উপযুপরি কতকগুলি অভাবনীয় ঘটনায় আমরা হঠাৎ আবিষ্কার করিয়াছি যে, বিনা চেষ্টায়, বিনা কারণে আমরা ভয় উৎপাদন করিতেছি। আমরা ভয়ংকর !! আশ্চর্য! ইহা আমরা পূর্বে কেহ সন্দেহই করি নাই। ইতিমধ্যে একদিন দেখিলাম, গবর্মেন্টু অত্যন্ত সচকিতভাবে তাহার পুরাতন দণ্ডশালা হইতে কতকগুলি অব্যবহৃত কঠিন নিয়মের প্রবল লীেহশৃঙ্খল টানিয়া বাহির করিয়া তাহার মরিচ সাফ করিতে বসিয়াছেন । প্রত্যহ-প্রচলিত আইনের মোটা কাছিতেও আমাদিগকে আর বঁাধিয়া রাখিতে পারে না- আমরা অত্যন্ত ভয়ংকর ! একদিন শুনিলাম, অপরাধিবিশেষকে সন্ধানপূর্বক গ্রেফতার করিতে অক্ষম হইয়া রোষারক্ত গবর্মেন্ট সাক্ষীসাব্বুদ-বিচার-বিবেচনার বিলম্বমাত্র না করিয়া একেবারে সমস্ত পুনা-শহরের বক্ষের উপর রাজদণ্ডের জগদ্দল পাথর চাপাইয়া দিলেন। আমরা ভাবিলাম, পুনা বড়ো ভয়ংকর শহর ! ভিতরে ভিতরে না জানি কী ভয়ানাক কাণ্ডই করিয়াছে ! আজ পর্যন্ত সে ভয়ানক কাণ্ডের কোনো অন্ধিসন্ধি পাওয়া গেল না । কাণ্ডটা সত্য অথবা স্বপ্ন ইহাই ভাবিয়া অবাক হইয়া বসিয়া আছি, এমন সময় তারের খবর আসিল, রাজপ্ৰসাদের গুপ্তচূড়া হইতে কোন-এক অজ্ঞাত অপরিচিত বীভৎস আইন বিদ্যুতের মতো পড়িয়া নাটুভ্রাতৃত্যুগলকে ছো মারিয়া কোথায় অন্তর্ধান করিয়াছে। দেখিতে দেখিতে আকস্মিক গুরুবর্ষার মতো সমস্ত বোম্বাই-প্রদেশের মাথার উপরে কালো মেঘ নিবিড় হইয়া উঠিল এবং জবরদস্ত শাসনের ঘন ঘন বজ্ৰপাত ও শিলাবৃষ্টির আয়ােজন-আড়ম্বরে আমরা ভাবিলাম।— ভিতরে কী ঘটিয়াছে জানি না, কিন্তু বেশ দেখিতেছি ব্যাপারটি সহজ নহে ; মারহাট্টারা বড়ো ভয়ংকর জাত ! এক দিকে পুরাতন আইন-শৃঙ্খলের মরিচ সাফ হইল, আবার অন্য দিকে রাজ-কারখানায় নূতন লীেহশৃঙ্খল-নির্মাণের ভীষণ হাতুড়িধ্বনিতে সমস্ত ভারতবর্ষ কম্পান্বিত হইয়া উঠিয়াছে। একটা ভয়ানক ধুম পড়িয়া গেছে। আমরা এতই ভয়ংকর ! আমরা এতকাল বিপুল পৃথিবীকে অচলা বলিয়া বিশ্বাস করিতাম, এবং এই প্রবলা বসুন্ধরার প্রতি আমরা যতই নির্ভর ও যতই উপদ্রব করিয়াছি তিনি তাহা অকুষ্ঠিত প্ৰকাণ্ড শক্তিতে অনায়াসে বহন করিয়াছেন। একদিন নববর্ষার দুর্যোগে মেঘবৃত অপরাহুে অকস্মাৎ আমাদের সেই চিরনির্ভর ভূমি জানি না কোন নিগুঢ় আশঙ্কায় কম্পান্বিত হইতে লাগিলেন । আমরা দেখিলাম, তাহার সেই মুহুর্তকালের চাঞ্চলে আমাদের বহুকালের প্রিয় পুরাতন বাসস্থানগুলি ধূলিসাৎ হইল। গবর্মেন্টের অচলা নীতিও যদি অকস্মাৎ সামান্য অথবা অনিৰ্দেশ্য আতঙ্কে বিচলিত ও বিদীর্ণ হইয়া আমাদিগকে গ্ৰাস করিতে উদ্যত হয় তাহা হইলে তাহার শক্তি ও নীতির দৃঢ়তা সম্বন্ধে আমাদের চিরবিশ্বাস হঠাৎ প্রচণ্ড আঘাত প্ৰাপ্ত হয়। সেই আঘাতে প্ৰজার মনে ভয়সঞ্চার হওয়া সম্ভবপর, কিন্তু সেইসঙ্গে নিজের প্রতিও তাহার অকস্মাৎ অত্যধিক মনোযোগ আকৃষ্ট হওয়া স্বাভাবিক। হঠাৎ এ প্রশ্নটা আপনিই মনে উদয় হয়- আমি না জানি কী ! সুতরাং ইহার মধ্যে আমাদের একটুখানি সত্ত্বনা আছে। কারণ, সম্পূর্ণ নিস্তেজ নিঃসত্ত্ব জাতির প্রতি বলপ্রয়োগ করা যেমন অনাবশ্যক তেমনি তাহাকে শ্রদ্ধা করাও অসম্ভব। আমাদিগকে দমন করিবার জন্য অতিরিক্ত আয়োজন দেখিলে ন্যায়-অন্যায় বিচার-অবিচারের তর্ক দূরে রাখিয়া এ কথা আমাদের স্বভাবতই মনে হয় যে, হয়তো আমাদের মধ্যে একটা শক্তির সম্ভাবনা আছে যাহা কেবল মুঢ়তাবশত আমরা সকল সময়ে উপলব্ধি করিতে পারি না। গবর্মেন্ট যখন চারি তরফ হইতেই কামান পাতিতেছেন তখন ইহা নিশ্চয় যে, আমরা মশা নহি, অন্তত মরা মশা নাহি । আমাদের স্বজাতির অন্তরে একটা প্ৰাণ একটা শক্তির সঞ্চার-সম্ভাবনা আমাদের পক্ষে পরমানন্দের বিষয় এ কথা অস্বীকার করা এমন সুস্পষ্ট কপটতা যে, তাহা পলিসিস্বরূপে অনাবশ্যক এবং