পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (পঞ্চম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬৭৮

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

রাজা প্রজা VS বহুকাল ধরিয়া পাইতেছে না বলিয়া উত্তরোত্তর পীড়িত হইয়া উঠিতেছে। ক্ষণস্থায়ী বহু রাজার দুঃসহ ভারে এই বৃহৎ দেশ কিরূপে মর্মে মর্মে ব্যথিত হইয়া উঠিয়াছে, প্রতিদিন কিরূপ নিরুপায়ভাবে দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিতেছে, তাহা অন্তর্যামী ছাড়া কেহ দেখিবার নাই। যাহারা পথিক মাত্র, ছুটির দিকেই যাহাদের মন পড়িয়া আছে, যাহারা পেটের দায়ে নির্বাসনে দিন যাপন করিতেছে, যাহারা বেতন লইয়া এই শাসন-কারখানার কল চালাইয়া যাইতেছে, যাহাদের সহিত আমাদের সামাজিক কোনো সম্বন্ধ নাই- অহরহ। পরিবর্তমান এমন উপেক্ষাপরায়ণ জনসম্প্রদায়ের হৃদয়সম্পর্কশূন্য আপিসি-শাসন নিরন্তর বহন করা যে কী দুর্বিষহ তাহা ভারতবৰ্ষই জানে। রাজভক্তিতে দীক্ষিত ভারতবর্ষের অন্তঃকরণ কাতরভাবে প্রার্থনা করিতেছে যে, হে ভারতের প্রতি বিমুখ ভগবান, আমি এই সকল ক্ষুদ্র রাজা, ক্ষণিক রাজা, অনেক রাজা আর সহিতে পারি না, আমাকে এক রাজা দাও । এমন রাজা দাও যিনি বলিতে পরিবেন, ভারতবর্ষ আমারই রাজ্য- বণিকের নয়, খনিকের নয়, চা-কারের নয়, রাজা নয়, ফুলার রাজা নয় ; পায়ােনিয়র-সম্পাদক রাজা নয়। রাজপুত্ৰ আসুন, ভারতের রাজতক্তে বসুন, তাহা হইলে স্বভাবতই তাহার নিকট ভারতবৰ্ষই মুখ্য এবং ইংলন্ড গীেণ হইয়া উঠিবে। তাহাতেই ভারতের মঙ্গল এবং ইংলন্ডের স্থায়ী লাভ । কারণ, মানুষকে কল দিয়া শাসন করিব, তাহার সহিত হৃদয়ের সম্পর্ক, সমাজের সম্পর্ক রাখিব না, এ স্পর্ধ ধর্মরাজ কখনোই চিরদিন সহ্য করিতে পারেন না— ইহা স্বাভাবিক নহে, ইহা বিশ্ববিধানকে পীড়িত করিতে থাকে। সেইজন্য, সুশাসনই বল, শান্তিই বল, কিছুর দ্বারাই এই দারুণ হৃদয়দুৰ্ভিক্ষ পূরণ হইতে পারে না। এ কথা শুনিয়া আইন ক্রুদ্ধ হইতে পারে, পুলিস-সর্প ফণা তুলিতে পারে ; কিন্তু যে ক্ষুধিত সত্য ত্ৰিশ কোটি প্রজার মর্মের মধ্যে হাহাকার করিতেছে তাহাকে বলের দ্বারা উচ্ছেদ করিতে পারে এমন শাসনের উপায় কোনো মানবের হাতে নাই, কোনো দানবের হাতে নাই । ভারতবষীয় প্রজার এই-যে হৃদয় প্রত্যহ ক্লিষ্ট হইতেছে, ইহাকেই কতকটা সত্ত্বনা দিবার জন্য রাজপুত্ৰকে আনা হইয়াছিল। আমাদিগকে দেখানো হইয়াছিল যে, আমাদেরও রাজা আছে। কিন্তু মরীচিকার দ্বারা সত্যকার তৃষ্ণা দূর হয় না। বস্তুত আমরা রাজশক্তিকে নহে- রাজহৃদয়কে প্রত্যক্ষ অনুভব করিতে ও প্রত্যক্ষ রাজাকে আমাদের হৃদয় অৰ্পণ করিতে চাই। ধনপ্রাণ সুরক্ষিত হওয়াই যে প্রজার চরম চরিতার্থতা, প্ৰভুগণ, এ কথা মনেও করিয়ো না । তোমরা আমাদিগকে নিতান্ত অবজ্ঞা করি বলিয়াই তোমরা বলিয়া থাক, ইহারা শান্তিতে আছে। তবু ইহারা আর কী চায়। ইহা জানিয়ো হৃদয়ের দ্বারা মানুষের হৃদয়কে বশ করিলে সে ধনপ্রাণ স্বেচ্ছাপূর্বক ত্যাগ করিতে পারে, ভারতের ইতিহাসে তাহার প্রমাণ আছে। শান্তি নহে, মানুষ তৃপ্তি চাহে, এবং দৈব আমাদের প্রতি যতই বিরূপ হউন, আমরা মানুষ। আমাদেরও ক্ষুধা দূর করিতে হইলে সত্যকার অন্নেরই প্রয়োজন হয়- আমাদের হৃদয় বশ করা ফুলার, পানিটিভ পুলিস এবং জোর-জুলুমের কর্ম নহে। দেবই হউন আর মানবই হউন, লাটই হউন আর জ্যাকই হউন, যেখানে কেবল প্ৰতাপের প্রকাশ, বলের বাহুল্য, সেখানে ভীত হওয়া নত হওয়ার মতো আত্মবিমাননা, অন্তর্যামী ঈশ্বরের অবমাননা, আর নাই। হে ভারতবর্ষ, সেখানে তুমি তোমার চিরদিনের উদার অভয় ব্ৰহ্মজ্ঞানের সাহায্যে এই সমস্ত লাঞ্ছনার উর্ধে তোমার মস্তককে অবিচলিত রাখো, এই সমস্ত বড়ো বড়ো নামধারী মিথ্যাকে তোমার সর্বািন্তঃকরণের দ্বারা অস্বীকার করে ; ইহারা যেন বিভীষিকার মুখোশ পরিয়া তোমার অন্তরাত্মাকে লেশমাত্র সংকুচিত করিতে না পারে। তোমার আত্মার দিব্যতা উজ্জ্বলতা পরম-শক্তিমত্তার কাছে এই সমস্ত তর্জন গর্জন, এই সমস্ত উচ্চপদের অভিমান, এই সমস্ত শাসন-শোষণের আয়োজন-আড়ম্বর তুচ্ছ ছেলেখেলা মাত্র। ইহারা যদি-বা তোমাকে পীড়া দেয়, তোমাকে যেন ক্ষুদ্র করিতে না পারে। যেখানে প্রেমের সম্বন্ধ সেইখানেই নত হওয়ায় গীেরব ; যেখানে সে সম্বন্ধ নাই সেখানে যাহাই ঘটুক, অন্তঃকরণকে মুক্ত রাখিয়াে, ঋজু রাখিয়াে, দীনতা স্বীকার করিয়াে না, ভিক্ষাবৃত্তি