পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (পঞ্চম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬৯৫

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

&9ዒbr রবীন্দ্র-রচনাবলী সেই-সকল শান্তিগভীর সনাতন কল্যাণবাক্যই আজ পরাস্ত হইবে ? ভারতবর্ষে আমরা মিলিব এবং মিলাইব, আমরা সেই দুঃসাধ্য সাধনা করিব যাহাতে শত্রুমিত্ৰভেদ লুপ্ত হইয়া যায় ; যাহা সকলের চেয়ে উচ্চ সত্য, যাহা পবিত্রতার তেজে, ক্ষমার বীৰ্যে, প্রেমের অপরাজিত শক্তিতে পূৰ্ণ আমরা তাহাকে কখনোই অসাধ্য বলিয়া জানিব না ; তাহাকে নিশ্চিত মঙ্গল জানিয়া শিরোধার্য করিয়া লইব । দুঃখবেদনার একান্ত পীড়নের মধ্য দিয়াই যাত্রা করিয়া আজ উদার আনন্দে মন হইতে সমস্ত বিদ্রোহভাব দূর করিয়া দিব ; জানিয়া এবং না জানিয়া বিশ্বের মানব এই ভারতক্ষেত্রে মনুষ্যত্বের যে পরমাশ্চর্য মন্দির নানা ধর্ম, নানা শাস্ত্ৰ, নানা জাতির সম্মিলনে গড়িয়া তুলিবার চেষ্টা করিতেছে সেই সাধনাতেই যোগদান করিব ; নিজের অন্তরের সমস্ত শক্তিকে একমাত্র সৃষ্টিশক্তিতে পরিণত করিয়া এই রচনাকার্যে তাহাকে প্রবৃত্ত করিব । তাহা যদি করিতে পারি, যদি জ্ঞানে প্রেমে ও কর্মে ভারতবর্ষের এই অভিপ্ৰায়ের মধ্যে সমস্ত প্ৰাণ দিয়া নিযুক্ত হইতে পারি, তবেই মোহমুক্ত পবিত্র দৃষ্টিতে স্বদেশের ইতিহাসের মধ্যে সেই এক সত্য, সেই নিত্য সত্যকে দেখিতে পাইব ঋষিরা যাহাকে বলিয়াছেন— স। সেতুবিধুতিরেষাং লোকনাম- , তিনিই সমস্ত লোকের বিধূতি, তিনিই সমস্ত বিচ্ছেদের সেতু এবং তঁহাকেই বলা হইয়াছে— তস্য হবা। এতস্য ব্ৰহ্মণোনাম সত্যমসেই যে ব্ৰহ্ম, নিখিলের সমস্ত প্রভেদের মধ্যে ঐক্যরক্ষার যিনি সেতু ইহারই নাম সত্য । \OS (? সমস্যা আমি ‘পথ ও পাথেয়’ নামক প্রবন্ধে আমাদের কর্তব্য এবং তাহার সাধনপ্রণালী সম্বন্ধে আলোচনা করিয়াছিলাম । উক্ত প্ৰবন্ধটিকে সকলে যে অনুকূলভাবে গ্রহণ করিবেন এমন আমি আশা করি নাই। কোনটা শ্রেয় এবং তাহা লাভের শ্রেষ্ঠ উপায়টি কী তাহা লইয়া তো কোনো দেশেই আজও তর্কের অবসান হয় নাই। মানুষের ইতিহাসে এই তর্ক কত রক্তপাতে পরিণত হইয়াছে এবং এক দিক হইতে তাহা বিলুপ্ত হইয়া আর-এক দিক দিয়া বার বার অঙ্কুরিত হইয়া উঠিয়াছে। আমাদের দেশে দেশহিত সম্বন্ধে মতভেদ এতকাল কেবল মুখে মুখে এবং কাগজে কাগজে কেবল ছাপাখানায় এবং সভাক্ষেত্রে কথার লড়াই রূপেই সঞ্চরণ করিয়াছে। তাহা কেবল ধোয়ার মতো ছড়াইয়াছে, voie Go N(\oi voy(on Rio | কিন্তু আজ নাকি সকলেই পরস্পরের মতামতকে দেশের হিতাহিতের সঙ্গে আসন্ন ভাবে জড়িত মনে করিতেছেন, তাহাকে কাব্যালংকারের ঝংকারমাত্র বলিয়া গণ্য করিতেছেন না, সেইজন্য র্যাহাদের সহিত আমার মতের অনৈক্য ঘটিয়াছে তাহদের প্রতিবাদবাক্যে যদি কখনো পরুষতা প্ৰকাশ পায় তাহাকে আমি অসংগত বলিয়া ক্ষোভ করিতে পারি না। এ সময়ে কোনো কথা বলিয়া কেহ অল্পের উপর দিয়া নিকৃতি পাইয়া যান নাইহা সময়ের একটা শুভ লক্ষণ সন্দেহ নাই । তবু তর্কের উত্তেজনা যতই প্রবল হােক, র্যাহাদের সঙ্গে আমাদের কোনো কোনো জায়গায় মতের অনৈক্য ঘটিতেছে দেশের হিতসাধনে তাহদের আন্তরিক নিষ্ঠা আছে। এই শ্রদ্ধা। যখন নষ্ট হইবার কোনো কারণ দেখি না তখন আমরা পরস্পর কী কথা বলিতেছি, কী ইচ্ছা করিতেছি, তাহা সুস্পষ্ট করিয়া বুঝিয়া লওয়া আবশ্যক । গোড়াতেই রাগ করিয়া বসিলে অথবা বিরুদ্ধপক্ষের বুদ্ধির প্রতি সন্দেহ করিলে নিজের বুদ্ধি হয়তো প্ৰতারিত করা হইবে । বুদ্ধির তারতম্যেই যে মতের অনৈক্য ঘটে এ কথা সকল সময়ে খাটে না । অধিকাংশ স্থলে প্রকৃতিভেদেই মতভেদ ঘটে। অতএব মতের ভিন্নতার প্রতি সম্মান রক্ষা করিলে যে নিজের বুদ্ধিবৃত্তির প্রতি অসম্মান করা হয় তাহা কদাচই সত্য নহে। এইটুকুমাত্র ভূমিকা করিয়া ‘পথ ও পাথেয় প্রবন্ধে যে আলোচনা উত্থাপিত করিয়াছিলাম তাহারই অনুবৃত্তি করিতে প্ৰবৃত্ত হইলাম । সংসারে বাস্তবের সঙ্গে আমাদিগকে কখনো আপস করিয়া কখনাে-বা লড়াই করিয়া চলিতে হয়।