পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (পঞ্চম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬৯৭

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

\ტხrO রবীন্দ্ৰ-রচনাবলী কিন্তু প্ৰবৃত্তি-চরিতার্থতাতেই বাস্তবের হিসাব অল্পই করিতে হয়, উপযোগিতায় তাহার চেয়ে অনেক বেশি করা আবশ্যক । মাটিনির পর যে ইংরেজেরা ভারতবর্ষকে নির্দয়ভাবে দালন করিতে পরামর্শ দিয়াছিল তাহারা মানবচরিত্রের বাস্তবের হিসাবটাকে অত্যন্ত সংকীর্ণ করিয়াই প্ৰস্তুত করিয়াছিল ; রাগের সময় এইপ্ৰকার সংকীর্ণ হিসাব করাই যে স্বাভাবিক, অর্থাৎ মাথা-গনতিতে অধিকাংশ লোকই করিয়া থাকে তাহা ঠিক, কিন্তু লর্ড ক্যানিং ক্ষমার দিক দিয়া যে বাস্তবের হিসাব করিয়াছিলেন তাহা প্রতিহিংসার হিসাব অপেক্ষা বাস্তবকে অনেক বৃহৎপরিমাণে, অনেক গভীর এবং দূরবিস্তৃতভাবেই গণনা করিয়াছিল । । কিন্তু যাহারা ক্রুদ্ধ তাহারা ক্যানিঙের ক্ষম্যনীতিকে সেন্টিমেন্টালিজম অর্থাৎ বাস্তববর্জিত ভাব-বাতিকতা বলিতে নিশ্চয়ই কুষ্ঠিত হয় নাই। চিরদিনই এইরূপ হইয়া আসিয়াছে। যে পক্ষ অক্ষৌহিণী সেনাকেই গণনাগৌরবে বড়ো সত্য বলিয়া মনে করে তাহারা নারায়ণকেই অবজ্ঞাপূর্বক নিজের পক্ষে না লইয়া নিশ্চিন্ত থাকে । কিন্তু জয়লাভকেই যদি বাস্তবতার শেষ প্ৰমাণ বলিয়া জানি, তবে নারায়ণ যতই একলা হােন এবং যতই ক্ষুদ্রমূর্তি ধরিয়া আসুন, তিনিই জিত।ইয়া দিবেন। আমার এত কথা বলিবার তাৎপর্য এই যে, যথার্থ বাস্তব যে কোন পক্ষে আছে তাহা সাময়িক উত্তেজনার প্রাবল্য বা লোকগণনার প্রাচুর্য হইতে স্থির করা যায় না । কোনো-একটা কথা শান্তরসাশিত বলিয়াই যে তাহা বাস্তবিকতায় খর্ব, এবং যাহা মানুষকে এত বেগে তাড়না করে যে পথ দেখিবার কোনো অবসর দেয় না। তাঁহাই যে বাস্তবকে অধিক মান্য করিয়া থাকে, এ কথা আমরা স্বীকার করিব না । ‘পথ ও পাথেয় প্রবন্ধে আমি দুইটি কথার আলোচনা করিয়াছি। প্রথমত, ভারতবর্ষের পক্ষে দেশহিত-ব্যাপারটা কী । অর্থাৎ তাহা দেশী কাপড় পরা বা ইংরেজ তাড়ানো বা আর-কিছু ? দ্বিতীয়ত, সেই হিতসাধন করিতে হইবে কেমন করিয়া । । w ভারতবর্ষের পক্ষে চরম হিত যে কী তাহা বুঝিবার বাধা যে কেবল আমরা নিজেরা উপস্থিত করিতেছি, তাহা নহে, বস্তুত তাহার সর্বপ্রধান বাধা আমাদের প্রতি ইংরেজের ব্যবহার । ইংরেজ কোনোমতেই আমাদের প্রকৃতিকে মানবপ্রকৃতি বলিয়া গণ্য করিতেই চায় না। তাহারা মনে করে, তাহারা যখন রাজা তখন জবাবদিহি কেবলমাত্র আমাদেরই ; তাহাদের একেবারেই নাই । বাংলাদেশের একজন ভূতপূর্ব হর্তাকর্তা ভারতবর্ষের চাঞ্চল্য সম্বন্ধে যতকিছু উন্ম প্রকাশ করিয়াছেন সমস্তই ভারতবাসীর প্রতি । তঁহার মত এই যে- কাগজগুলাকে উচ্ছেদ করো, সুরেন্দ্রর্বাড়ুজ্যে-বিপিনপালকে দমন করিয়া দাও । দেশকে ঠাণ্ডা করিবার এই একমাত্র উপায় যাহারা অনায়াসে কল্পনা ও নিঃসংকোচে প্রচার করিতে পারে তাহদের মতো ব্যক্তি যে আমাদের শাসনকর্তার পদে প্রতিষ্ঠিত ছিল ইহাই কি দেশের রক্ত গরম করিয়া তুলিবার পক্ষে অন্তত একটা প্রধান কারণ নহে। ইংরেজের গায়ে জোর আছে বলিয়াই মানবপ্রকৃতিকে মানিয়া চলা কি তাহার পক্ষে একেবারেই অনাবশ্যক। ভারতবর্ষের চাঞ্চল্য-নিবারণের পক্ষে ভারতের-পেনসন-ভোগী এলিয়টের কি তাহার জাতভাইকে একটি কথাও বলিবার নাই। যাহাদের হাতে ক্ষমতা অজস্র তাহাদিগকেই আত্মসংবরণ করিতে হইবে না, আর যাহারা স্বভাবতই অক্ষম শমদমনিয়মসংযমের সমস্ত ব্যবস্থা কেবল তাহাদেরই জন্য ! তিনি লিখিয়াছেন, ভারতবর্ষে ইংরেজের গায়ে যাহারা হাত তোলে তাহারা যাহাতে কোনোমতেই নিষ্কৃতি না পায় সেজন্য সতর্ক হইতে হইবে । আর যে-সকল ইংরেজ ভারতবর্ষীয়কে হত্যা করিয়া কেবলই দণ্ড হইতে অব্যাহতি পাইয়া ব্রিটিশ-বিচার সম্বন্ধে চিরস্থায়ী কলঙ্কের রেখা আগুন দিয়া ভারতবর্ষের চিত্তে দাগিয়া দাগিয়া দিতেছে তাহাদের সম্বন্ধেই সতর্ক হইবার কোনাে প্রয়ােজন নাই ? বলদৰ্পে অন্ধ ধর্মবুদ্ধিহীন এইরূপ স্পর্ধাই কি ভারতবর্ষে ইংরেজশাসনকে এবং ইংরেজের প্রজাকে উভয়কেই ভ্ৰষ্ট করিতেছে না । অক্ষম যখন অস্থিমজ্জায় জ্বলিয়া জ্বলিয়া মরে, যখন হাতে হাতে অপমানের প্রতিশোধ লওয়ার কাছে মানবধর্মের আর-কোনো উচ্চতর দাবি তাহার কাছে কোনোমতেই রুচিতে চাহে না, তখন কেবল ইংরেজের রক্তচক্ষু পিনাল-কোেডই ভারতবর্ষে শান্তিবর্ষণ করিতে পারে এত শক্তি ভগবান ইংরেজের