পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (পঞ্চম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৭১৯

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

aos রবীন্দ্র-রচনাবলী সমান চালে পা ফেলে ; তখন পদাতিকের দল একটু যদি পাশ কাটাইয়া চলিতে পারে তবে তাহদেব আর অপঘাতের আশঙ্কা থাকে না । কিন্তু চরমনীতি যখনই রাশ ছাড়িয়া দেয়। তখনই এই বিরাট । শাসনতন্ত্রের মধ্যে অবারিত জীবপ্রকৃতি দেখিতে দেখিতে বিচিত্র হইয়া উঠে। তখন কোন পাহারাওয়ালার যষ্টি যে কোন ভালোমানুষের কপাল ভাঙিবে এবং কোন বিচারকের হাতে আইন যে কিরূপ ভয়ংকর বক্ৰগতি অবলম্বন করিবে তাহা কিছুই বুঝিবার উপায় থাকে না । তখন প্রজাদের মধ্যে যে বিশেষ অংশ প্রশ্রয় পায় তাহারাও বুঝিতে পারে না তাহাদের প্রশ্রয়ের সীমা কোথায় । চতুর্দিকে শাসননীতির এইরূপ অদ্ভুত দুর্বলতা প্রকাশ হইতে থাকিলে গবর্মেন্ট নিজের চালে নিজেই কিছু কিছু লজ্জাবোধ করিতে থাকেন । তখন লজানিবারণের কমিশন, রিপোটের তালি দিয়া শাসনের ছিন্নতা ঢাকিতে চায়- যাহারা আর্ত তাহাদিগকে মিথুক বলিয়া অপমানিত করে এবং যাহারা উচ্ছঙ্খল তাহাদিগকেই উৎপীড়িত বলিয়া মার্জনা করে । কিন্তু এমন করিয়া লজ্জা কি ঢাকা পড়ে। অথচ এই-সমস্ত উদ্দাম উৎপাত সংবরণ করাকেও ত্রুটিস্বীকার বলিয়া মনে হয় এবং দুর্বলতাকে প্রবলভাবে সমর্থন করাকেই রাজপুরুষ শক্তির পরিচয় বলিয়া ভ্ৰম করেন । অন্য পক্ষে আমাদের মধ্যেও চরমনীতিকে সর্বদা ঠিকমত সংবরণ করিয়া চলা দুঃসাধ্য। আমাদের মধ্যেও নিজের দলের দুর্বরতা দলপতিকেও টলাইতে থাকে । এরূপ অবস্থায় কাহার আচরণের জন্য যে কাহাকে দায়ী করা যাইবে এবং কোন মতটা যে কতটা পরিমাণে কাহার, তাহা নিশ্চয় করিয়া নির্ণয় করে এমন কে আছে । 弱 এইখানে একটি কথা মনে রাখিতে হইবে । একট্ৰিমিস্ট নাম দিয়া আমাদের মাঝখানে যে-একটা সীমানার চিহ্ন টানিয়া দেওয়া হইয়াছে সেটা আমাদের নিজের দত্ত নহে। সেটা ইংরেজের কালো কালির দাগ। সুতরাং এই জরিপের চিহ্নটা কখন কতদূর পর্যন্ত ব্যাপ্ত হইবে বলা যায় না। দলের গঠন অনুসারে নহে, সময়ের গতি ও কর্তৃজাতির মর্জি অনুসারে এই রেখার পরিবর্তন হইতে থাকিবে } অতএব ইংরেজ তাহার নিজের প্রতি আমাদের মনের ভাব বিচার করিয়া যাহাকে একট্ৰিমিস্ট দল বলিয়া নির্দেশ করিবার চেষ্টা করিতেছে সেটা কি একটা দল, না দলের চেয়ে বেশি- তাহা দেশের একটা লক্ষণ ? কোনো-একটা দলকে চাপিয়া মারিলে এই লক্ষণ আর-কোনো আকারে দেখা দিবে। অথবা ইহা বাহির হইতে ভিতরে প্রবেশ করিবে ? কোনো স্বাভাবিক প্ৰকাশকে যখন আমরা পছন্দ না করি তখন আমরা বলিতে চেষ্টা করি যে, ইহা কেবল সম্প্রদায়বিশেষের চক্রান্ত মাত্র। অষ্টাদশ শতাব্দীতে য়ুরোপে একটা ধুয়া উঠিয়াছিল যে, ধর্ম-জিনিসটা কেবল স্বার্থপর ধর্মযাজকদের কৃত্রিম সৃষ্টি ; পাদ্রিদিগকে উচ্ছিন্ন করিলেই ধর্মের আপদটাকেই একেবারে দূর করিয়া দেওয়া যায়। হিন্দুধর্মের প্রতি যাহারা অসহিষ্ণু তাহারা অনেকে বলিয়া থাকে, এটা যেন ব্ৰাহ্মণের দল পরামর্শ করিয়া নিজেদের জীবিকার উপায়স্বরূপে তৈরি করিয়া তুলিয়াছে- অতএব ভারতবর্ষের বাহিরে কোনো গতিকে ব্ৰাহ্মণের ডিপোর্টেশন ঘটাইতে পারিলেই হিন্দুধর্মের উপদ্রব সম্বন্ধে একপ্রকার নিশ্চিন্ত থাকা যাইবে । আমাদের রাজারাও সেইরূপ মনে করিতেছেন, একৃস্ট্রিমিজম বলিয়া একটা উৎক্ষেপক পদার্থ দুষ্ট্রের দল তাঁহাদের ল্যাবরেটরিতে কৃত্রিম উপায়ে তৈরি করিয়া তুলিতেছে, অতএব কয়েকটা দলপতি ধরিয়া পুলিস-ম্যাজিষ্ট্রেটের হাতে সমর্পণ করিয়া দিলেই উৎপাতশান্তি হইতে পরিবে । ) কিন্তু আসল কথাটা ভিতরের কথা। সেটা চােখে দেখার জিনিস নাহে, সেটা তলাইয়া বুঝতে যে সত্য অব্যক্ত ছিল সেটা হঠাৎ প্রথম ব্যক্ত হইবার সময় নিতান্ত মৃদুমন্দ মধুর ভাবে হয় না। তাহা একটা ঝড়ের মতো আসিয়া পড়ে, কারণ অসামঞ্জস্যের সংঘাতই তাহাকে জাগাইয়া তোলে । আমাদের দেশে কিছুকাল হইতেই ইতিহাসের শিক্ষায়, যাতায়াত ও আদান-প্রদানের সুযোগে, এক রাজশাসনের ঐক্যে, সাহিত্যের অভ্যুদয়ে এবং কনগ্রেসের চেষ্টায় আমরা ভিতরে ভিতরে বুঝিতেছিলাম যে—“আমাদের দেশটা এক, আমরা একই জাতি, সুখে দুঃখে আমাদের এক দশা, এবং P