পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (পঞ্চম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৭২০

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

সমূহ · ዒox© পরস্পরকে পরমাত্মীয় বলিয়া না জানিলে ও অত্যন্ত কাছে না। টানিলে আমাদের কিছুতে মঙ্গল নাই। বুঝিতেছিলাম বটে, কিন্তু এই অখণ্ড ঐক্যের মূর্তিটি প্রত্যক্ষ সত্যের মতো দেখিতে পাইতেছিলাম না । তাহা যেন কেবলই আমাদের চিন্তার বিষয় হইয়াই ছিল । সেইজন্য সমস্ত দেশকে এক বলিয়া আমরা তাহার কিছুই পারি নাই । এইভাবেই আরো অনেক দিন চলিত। এমন সময় লর্ড কার্জন যবনিকার উপর এমন-একটা প্রবল টান মারিলেন যে, যাহা নেপথ্যে ছিল তাহার। আর কোনো আচ্ছাদন রহিল না । বাংলাকে যেমনি দুইখানা করিবার হুকুম হইল অমনি পূর্ব হইতে পশ্চিমে একটিমাত্র ধ্বনি জাগিয়া উঠিল— আমরা যে বাঙালি, আমরা যে এক ! বাঙালি কখন যে বাঙালির এতই কাছে আসিয়া পড়িয়ছে, রক্তের নাড়ি কখন বাংলার সকল অঙ্গকেই এমন করিয়া এক চেতনার বন্ধনে বাধিয়া তুলিয়াছে, তাহা তো পূর্বে আমরা এমন স্পষ্ট করিয়া বুঝিতে পারি নাই। আমাদের এই আত্মীয়তার সজীব শরীরে বিভাগের বেদনা যখন এত অসহ্য হইয়া বাজিল তখন ভাবিয়ছিলাম, সকলে মিলিয়া রাজার দ্বারে নালিশ জানাইলেই দয়া পাওয়া যাইবে । কেবলমাত্র নালিশের দ্বারা দয়া আকর্ষণ ছাড়া আর যে আমাদের কোনো গতিই আছে তাহাও আমরা জানিতাম की । কিন্তু নিরুপায়ের ভরসাস্থল এই পরের অনুগ্রহ যখন চূড়ান্তভাবেই বিমুখ হইল তখন যে ব্যক্তি নিজেকে পঙ্গু জানিয়া বহুকাল অচল হইয়া ছিল, ঘরে আগুন লাগিতেই নিতান্ত অগত্যা দেখিতে পাইল- তাহারও চলৎশক্তি আছে। আমরাও একদিন অন্তঃকরণের অত্যন্ত একটা তাড়নায় দেখিতে পাইলাম— এই কথাটা আমাদের জোর করিয়া বলিবার শক্তি আছে যে, আমরা বিলাতি পণ্যদ্রব্য ব্যবহার করিব না | আমাদের এই আবিষ্কারটি অন্যান্য সমস্ত সত্য-আবিষ্কারেরই ন্যায় প্রথমে একটা সংকীর্ণ উপলক্ষকে অবলম্বন করিয়া আমাদের কাছে উপস্থিত হইয়াছিল। অবশেষে দেখিতে দেখিতে আমরা বুঝিতে পারিলাম, উপলক্ষটুকুর অপেক্ষা ইহা অনেক বৃহৎ । এ যে শক্তি। এ যে সম্পদ। ইহা অন্যকে জব্দ করিবার নহে, ইহা নিজেকে শক্ত করিবার। ইহার আর কোনো প্রয়োজন থাক বা না থাক, ইহাকে বক্ষের মধ্যে সত্য বলিয়া অনুভব করাই সকলের চেয়ে বড়ো প্রয়োজন হইয়া উঠিয়াছে। শক্তির এই অকস্মাৎ অনুভূতিতে আমরা যে একটা মস্ত ভরসাের আনন্দ পাইয়াছি সেই আনন্দচুকু না থাকিলে এই বিদেশীবর্জন ব্যাপারে আমরা এত অবিরাম দুঃখ কখনোই সহিতে পারিতাম না । কেবলমাত্র ক্রোধের এত সহিষ্ণুতা নাই। বিশেষত প্রবলের বিরুদ্ধে দুর্বলের ক্ৰোধ কখনোই এত জোরের সঙ্গে দাড়াইতে পারে না । এদিকে দুঃখ যতই পাইতেছি সত্যের পরিচয়ও ততই নিবিড়তর সত্য হইয়া উঠিতেছে। যতই দুঃখ পাইতেছি আমাদের শক্তি গভীরতায় ও ব্যাপ্তিতে ততই বাড়িয়া চলিয়াছে। আমাদের এই বড়ো দুঃখের ধন ক্রমেই আমাদের হৃদয়ের চিরন্তন সামগ্ৰী হইয়া উঠিতেছে। অগ্নিতে দেশের চিত্তকে বার বার গলাইয়া এই-যে ছাপ দেওয়া হইতেছে, ইহা তো কোনোদিন আর মুছিবে না। এই রাজ-মোহরের ছাপ আমাদের দুঃখ সাহার দলিল হইয়া থাকিবে। দুঃখের জোরে ইহা প্রস্তুত হইয়াছে এবং ইহার জোরেই দুঃখ সহিতে পারিব। এইরূপে সত্য জিনিস পাইলে তাহার আনন্দ যে কত জোরে কাজ করে এবার তাহা স্পষ্ট দেখিয়া আশ্চর্য হইয়া গিয়াছি। কতদিন হইতে জ্ঞানী লোকেরা উপদেশ দিয়া আসিয়াছেন যে, হাতের কাজ করিতে ঘূণা করিয়া চাকরি করাকেই জীবনের সার বলিয়া জানিলে কখনোই আমরা মানুষ হইতে পারিব না। যে শুনিয়াছে সেই বলিয়াছে, হাঁ কথাটা সত্য বটে। অমনি সেইসঙ্গেই চাকরির দরখাস্ত লিখিতে হাত পাকাইতে বসিয়াছে। এতবড়ো চাকরিপিপাসু বাংলাদেশেও এমন-একটা দিন আসিল যেদিন কিছু না বলিতেই ধনীর ছেলে নিজের হাতে তাত চালাইবার জন্য র্তাতির কাছে শিষ্যবৃত্তি