পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (পঞ্চম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৭২৩

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

१०७ রবীন্দ্র রচনাবলী তেমন উপায় পৃথিবীতে নাইও । আমরা কোনো শ্রেয় পদার্থকেই পরের কৃপার দ্বারা পাই না, নিজের শক্তির দ্বারাই লই । ইহার অন্যথা হইতেই পারে না । কারণ, বিধাতা। বরঞ্চ আমাদিগকে হনন করিতে পারেন, কিন্তু মনুষ্যত্বকে অপমানিত হইবার পথে কোনো প্রশ্রয় দেন না । সেইজন্যই দেখিতে পাই, গবর্মেন্টের দানের সঙ্গে যেখানেই আমাদের শক্তির কোনো সহযোগিতা নাই সেখানে সেই দানই বক্র হইয়া উঠিয়া আমাদের কত-না বিপদ ঘটাইতে পারে। প্রশ্রয়প্রাপ্ত পুলিস যখন দস্যবৃত্তি করে তখন প্রতিকার অসম্ভব হইয়া উঠে ; গবর্মেন্টের-প্রসাদ-ভোগী পঞ্চায়েত যখন গুপ্তচরের কাজ আরম্ভ করে তখন গ্রামের পক্ষে তাহা যে কতবড়ো উপদ্রবের কারণ হইতে পারে তাহা কিছুই বলা যায় না ; গবর্মেন্টের চাকরি যখন শ্রেণী বিশেষকেই অনুগ্রহভাজন করিয়া তোলে তখন ঘরের লোকের মধ্যেই বিদ্বেষ জ্বলিয়া উঠে ; এবং রাজমন্ত্রিসভায় যখন সম্প্রদায়বিশেষের জন্যই আসন প্রশস্ত হইতে থাকে তখন বলিতে হয়, আমার উপকারে কাজ নাই, তোমার অনুগ্রহ ফিরাইয়া লও । আমাদের নিজের মধ্যে সতেজ শক্তি থাকিলে এই সমস্ত বিকৃতি কিছুতেই ঘটিতে পারিত নাআমরা দান গ্ৰহণ করিবার ও তাহাকে রক্ষা করিবার অধিকারী হাইতাম, দান আমাদের পক্ষে কোনো অবস্থাতেই বলিদান হইয়া উঠিত না । অতএব আমি যাহা বলিতেছি তাহাতে এ বোঝায় না যে, আমাদের কর্মের কোনো উপকরণ আমরা গবর্মেন্টের নিকট হইতে লইব না, কিন্তু ইহাই বুঝায় যে, নিজের সম্পূর্ণ সাধ্যমত যদি কর্মে প্রবৃত্ত হই তবেই তাহার উপকরণ আমরা সকল স্থান হইতেই অসংকোচে সংগ্ৰহ করিবার অধিকারী হইব । নতুবা আমাদের সেই গল্পের দশা ঘটিবে ; আমরা মা-কালীর কাছে মহিষ মানত করিবার বেলা চিন্তা করিব না। বটে, কিন্তু পরে তিনি যখন অনেক ক্ষমা করিয়াও একটিমাত্র পতঙ্গ দাবি করিবেন তখন বলিব- মা, ওটা তুমি নিজে ক্ষেত্রে গিয়া ধরিয়া লও গে। আমরাও কথার বেলায় বড়ো বড়ো করিয়াই বলিব, কিন্তু তুমি দেশের একটি সামান্য হিতসাধনের বেলাতেও অন্যের উপরে বরাত দিয়া পায় সারিবার ইচ্ছা রব | কাজে প্রবৃত্ত হইতে গেলে, রাগ করিয়া, গর্ব কবিয়া, বা অন্য কারণে, যে জিনিসটা নিশ্চিত আছে তাহাকে নাই বলিয়া হিসাব হইতে বাদ দিয়া বসিলে চলিবে না। ভারতে ইংরাজ-গবর্মেন্ট যেন একেবারেই নাই এমনভাবে চক্ষু মুদ্রিত করিয়া থাকা শয়নাগারেই চলে, কিন্তু কর্মক্ষেত্রে সেরূপভাবে চলিলেই নিশ্চয় ঠকিতে হইবে । অবশ্য এ কথাও সত্য, ইংরেজও যতদূর সম্ভব এমনভাবে চলিতেছে যেন আমরা কোথাও নাই। আমাদের ত্ৰিশ কোটি লোকের মাঝখানে থাকিয়াও তাহারা বহুদূরে। সেইজন্যই আমাদের সম্বন্ধে তাহদের পরিমাণবোধ একেবারেই চলিয়া গেছে। সেইজন্যই পনেরো বৎসরের একটি ইস্কুলের ছেলেরও একটু তেজ দেখিলে তাহারা জেলের মধ্যে তাহাকে বেত মারিতে পারে ; মানুষ সামান্য একটু নড়িলে চড়িলেই পানিটিভ পুলিসের চাপে তাহাকে সম্পূর্ণ নিশ্চল করিয়া ফেলিতে মনে তাহাদের ধিক্কার বোধ হয় না ; এবং দুর্ভিক্ষে মরিবার মুখে লোকে যখন বিলাপ করিতে থাকে সেটাকে অত্যক্তি বলিয়া অগ্রাহ্য করা তাঁহাদের পক্ষে সম্ভব হয়। সেইজন্যই বাংলার বিভাগ-ব্যাপারে সমস্ত বাঙালিকেই বাদ দিয়া মর্লি সেটাকে ‘সেটুলড় ফ্যাক্ট বলিয়া গণ্য করিতে পারিয়াছেন । এইরূপে আচারে বিচারে এবং রাষ্ট্রবিধানে যখন দেখিতে পাই, ইংরাজের খাতায় হিসাবের অঙ্কে আমরা কতবড়ো একটা শূন্য, তখন ইহার পাল্টাই দিবার জন্য আমরাও উহাদিগকে যতদূর পারি অস্বীকার করিবার ভঙ্গি করিতে ইচ্ছা করি । কিন্তু খাতায় আমাদিগকে একেবারে শূন্যের ঘরে বসাইয়া গেলেও আমরা তাে সত্যই একেবারে শূন্য নাহি। ইংরেজের শুমার-নবিশ ভুল হিসাবে যে অঙ্কটা ক্রমাগতই হরণ করিয়া চলিতেছে তাহাতে তাহার সমস্ত খাতা দূষিত হইয়া উঠিতেছে। গায়ের জোরে 'হাঁকে “না করিলে গণিতশাস্ত্ৰ ক্ষমা করিবার লোক নয় । এক পক্ষে এই ভুল করিতেছে বলিয়া রাগ করিয়া আমরাও কি সেই ভুলটাই করিব ; পরের উপর