পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (পঞ্চম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৭৫০

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

পরিশিষ্ট VO) বেশি- এবং ভারত-গবর্মেন্টের যেরূপ মেজাজ। তাহাতে প্লেগ অপেক্ষা প্লেগ-রেগুলেশন বেশি রুদ্রমূর্তি ধারণ করিয়া উঠিবে। সতর্ক থাকিলে প্লেগের হস্ত অনেকে এড়াইবে, কিন্তু রেগুলেশনের হন্তে কাহারও রক্ষা নাই । ] এমন সময় বুডুবর্ন-সাহেব মাভৈঃ ধ্বনি ঘোষণা করিলেন। বুঝিলাম, বাংলাদেশে রাজার অভ্যূদয় হইয়াছে ; এখানে রেগুলেশন-নামক এঞ্জিনের শাসন নহে, রাজার রাজ্য । ইহাতেই রাজভক্তি জাগিয়া উঠে। রাজার ইচ্ছা আমার ইচ্ছার সহিত একভাবে মিলিতে পারে ইহা জানিতে পারিলে রাজাকেও ৷ মনুষ্য বলিয়া গ্ৰীতি করি এবং আপনার প্রতিও মনুষ্য বলিয়া শ্রদ্ধা জন্মে। এ কথা কেহই অস্বীকার করিতে পরিবেন না যে, আজকাল কিপলিং প্রভৃতি বিখ্যাত লেখকগণের উপন্যাসে ভারতবর্ষ ও তাহার অধিবাসীবৰ্গ যেরূপ বর্ণে চিত্রিত হইতেছে এবং ভারতবর্ষীয় ইংরাজদের মধ্যে এ-দেশীয়দের বিরুদ্ধে ক্রমশই যে-একটা সাম্প্রদায়িক সংস্কার বদ্ধমূল হইয়া যাইতেছে এবং যাহার অবশ্যম্ভাবী প্ৰতিঘাতস্বরূপে উত্তরোত্তর ভারতবাসীর মনে ইংরাজ ও সর্বপ্রকার ইংরাজি প্রভাবের প্রতিকূলে যে-একটা পরাস্তুখভােব বৃদ্ধি পাইতেছে, অল্পে অল্পে তাহার প্রতিকার-সাধন করিতে পারেন। পশ্চিমের ম্যাকডোনেল, এবং আশা করি আমাদের বুডুবর্ন-সাহেবের ন্যায় ক্ষমা-ধৈর্য-পরায়ণ সহৃদয় শাসনকর্তৃগণ । কঠিন আইন ও জবরদস্তিতে সম্পূর্ণ উলটা ফল ফলিবে, ইহা আমরা জোর করিয়া বলিতে পারি। - এখন এমন-একটা অবস্থা দাড়াইয়াছে যে, ইংরাজ এবং দেশী উভয়েই পরস্পর পরস্পরকে ভুল কিন্তু ক্ষমতা যাহার হস্তে বিচারের শেষ ফল সেই দিতে পারে । আমাদের মন বিগড়াইয়া গেলে আমরা কাগজে দু-চার কথা বলিতে পারি, কিন্তু কর্তৃপক্ষের মন বিগড়াইয়া গেলে তাহারা আমাদের কাগজের গলা চাপিয়া ধরিতে পারেন। আমরা ক্ষুব্ধ হইলে তাহা রাজবিদ্রোহ। কিন্তু রাজারা রুখিয়া থাকিলে তাহা কি প্ৰজাবিদ্রোহ নহে। উভয়েরই ফল কি রাজ্যের পক্ষে সমান অমঙ্গলজনক নহে । কিন্তু দুই দিক বিচার করা কাজটা কঠিন, বিশেষত দুই দিকের মধ্যে এক দিক যখন নিজের দিক । তথাপি নীতিতত্ত্ববিৎমাত্রেই বলিয়া থাকেন, পরের অপেক্ষা নিজেকে কঠিন বিচারাধীনে আনিলে নিজের পক্ষেই মঙ্গল । ঈসপের কথামালায় আছে— কানা হরিণ পরপারের দিকে দৃষ্টি রাখিয়া ঘাস খাইত, তাহার নিজ পারের দিক হইতেই ব্যাধের শর তাহাকে বিদ্ধ করিয়াছিল। নিজের দিকে সকলে কানা, এইজন্য সর্বাপেক্ষা গুরুতর অকল্যাণ সেই দিকেই প্রবল হইয়া উঠে । আমাদেরও সেই দশা, ইংরাজেরও তাই। যাহা সর্বাগ্রে আমাদের নিজের কর্তব্য তাহার প্রতি আমরা উদাসীন এবং গবর্মেন্টের কর্তব্যের প্রতি আমাদের শত চক্ষু এবং সহস্র জিহবা । ইংরাজেরও প্রজার সামান্যমাত্র চাঞ্চল্যের প্রতি রুদ্র রূপ, কিন্তু নিজে যে প্রতিদিন ঔদ্ধত্য ও অবমাননার দ্বারা প্রজাসাধারণকে নানা আকারে ক্ষুব্ধ করিয়া তুলিতেছেন তাহার বিষময়তার প্রতি কর্তৃপক্ষের শৈথিল্য থাকাতে তাহা প্রশ্রয় পাইয়া বিরাটমুর্তি ধারণ করিতেছে। অনিচ্ছা সত্ত্বেও আমরা একটা উদাহরণ দিতেছি। অনিচ্ছার কারণ এই বারংবার নিজেদের এই সকল হীনতার দৃষ্টান্ত আলোচনা করিতে সংকোচ বোধ হয়। মাঝে মাঝে প্রায়ই শুনা যায়, গোরা সৈন্য শিকার-উপলক্ষে এ-দেশী গ্রামবাসীর হত্যার কারণ হইয়া পড়ে। মান্দ্ৰাজে ঘণ্টাকুলের হত্যা ৰূপ ধারণীর মহািবলে এক্স ভর্তিত হয়েছে যে, তাই বিশ্বত হওয়া ভারতবাসীর পক্ষে দেশীয় লোককে হত্যা করিয়া এ-পর্যন্ত বাংলাদেশে কেবল বহুকাল পূর্বে একজন ইংরাজের ফঁাসি হইয়াছিল। অভিযুক্তগণ খালাস পাইয়াছে। অবশ্য, সেটা প্রমাণ এবং ইংরাজ জজ ও জুরির বিচার ও বিশ্বাসের কথা। কিন্তু এরূপ দুর্ঘটনা বারংবার না ঘটিতে পারে। গবর্মেন্টু তজন্য কোনো বিশেষ বিধান করিয়াছেন বলিয়া বােধ হয় না। অথচ ইহাতে করিয়া কোনাে পােলিটিকাল কুফল সঞ্চিত হইতেছে না এমন কে বলিতে পারে । v