পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (পঞ্চম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৭৫১

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

ԳV28 D রবীন্দ্ৰ-রচনাবলী সম্প্রতি ব্যারাকপুরে একজন সন্ত্রান্ত বাঙালি ভদ্রলোক তিনজন গোরা সৈন্যের দ্বারা যেরূপ নিষ্ঠুরভাবে হত হইয়াছেন তাহা পাঠকগণ জানেন। অবশ্য ইহার বিচার হইবে এবং দােষীগণ দণ্ড পাইবে এমনও আশা করা যাক । কিন্তু ইতিমধ্যে ইংরাজ-চালিত কোনো খবরের কাগজে এই নিদারুণ ঘটনা উপলক্ষে কিছুমাত্র বিরক্তি খেদ অথবা রোষ প্রকাশ হইয়াছে ? প্রমাণের ত্রুটি অবলম্বন করিয়া আদালতের হস্ত হইতে দোষী নিষ্কৃতি পাইতে পারে, কিন্তু ইংরাজী-সাধারণের ক্ষুব্ধ ন্যায়ানুরাগ যদি এই পাপকাৰ্যকে লেশমাত্র লাঞ্ছিত না করে তবে তাহা হইতে কী প্রমাণ হয় । অথচ হাওড়ায় কোনো-একটি য়ুরোপীয়-হত্যা লইয়া সেই সকল ইংরাজি কাগজের ইংরাজ পত্রপ্রেরকগণ কিরূপ উত্তেজনা ও আক্রোশ প্রকাশ করিতেছেন । হাওড়ার এই হত্যাকাণ্ড অত্যন্ত নিষ্ঠুর ও শোচনীয় সন্দেহ নাই এবং তাঁহার বিচার কঠিন ও দণ্ড সুকঠোর হইবে না। এমন আশঙ্কাও কেহ মনে স্থান দিতে পারে না । কিন্তু উভয় হত্যার মধ্যে অনেক প্রভেদ আছে। জনসাধারণ যখন অমূলক অথবা সমূলক আশঙ্কায় ত্ৰস্ত হইয়া উঠে তখন তাহারা যেরূপ ভীষণ মূর্তি ধারণ করে তাহা অন্য দেশের তুলনায় এ দেশে কিছুই নহে। সেইরূপ উত্তেজিত অবস্থায় যে দুই-একটা অন্যায় হত্যা সংঘটিত হইবে তাঁহাতে বিচিত্র কী আছে। কিন্তু ব্যারাকপুরে বিনা কারণে যে হত্যা ঘটিয়াছে তাহার মূলে বহুকালের স্পর্ধা ও প্রশ্ৰয় আছে- প্লেগ-ঘটিত উত্তেজনা সম্ভব, কিন্তু শেষোক্ত কারণ -জনিত দুর্ঘটনা ধারাবাহিক । তাহার বিষবীজ সংক্ৰামক এবং একটি গোরা পুনা-রাজপথে বায়ু-বন্দুক ষ্টুড়িয়া আমোদ করিতেছিল, তাহার বিবরণ কাগজে প্রকাশিত হইয়াছে । তিনজনের গায়ে গুলি লাগে | আঘাত অতি সামান্য, এবং সে হিসাবে অপরাধ গুরুতর নহে। কিন্তু এই খেলার মধ্যে যে-একটা নিষ্ঠুর অবজ্ঞা অবহেলা আছে তাহা ভারতবাসীর পক্ষে বিপজ্জনক, এবং কর্তৃপুরুষের পক্ষেও চিন্তার কারণ হওয়া উচিত ছিল। অপরাধী স্বীকার $frica (R, "He fired at a coffee shop sweeper for a lark-Vais, Gi Gi-total 4 মজা করিয়া একজন কফি-দোকানের ঝাড়ুদারকে গুলি করিয়াছিল। এই গুলি ঝাড়ুদারের গাত্রে অধিক দূর প্রবেশ করে নাই, কিন্তু এইরূপ মজা ভারতবর্ষের মর্মের মধ্যে গভীররূপে নিহিত হইয়া থাকে । এ কথা অস্বীকার করিতে পারি না যে, যে জাতি অতিমাত্রায় নিরীহ তাহাকে পদে পদে আঘাত ও অপমান হইতে রক্ষা করিতে কোনো গবর্মেন্টই কৃতকাৰ্য হইতে পারে না। এই সকল ক্ষুদ্র বিপদ হইতে নিজের পৌরুষই নিজেকে উদ্ধার করে । ইহার জন্য কাহারও কাছে কাদিয়া গিয়া পড়ার মতো লজ্জা আর নাই । w সেইজন্য ছােটােখাটাে উপদ্রব এবং অপমানের কথায় নিজেদেরই প্রতি ধিক্কার জন্মে। সেতারার স্কুল-মাস্টারের কুষ্ঠিত সেলাম সাহেবের পক্ষে যথোপযুক্ত না হওয়ায় যে একটা লাঞ্ছনা ও নালিশের সৃষ্টি করিয়াছে তাহা আমরা লজ্জাজনক জ্ঞান করি। প্রত্যক্ষ অপমান যে দেশে সুমন্দগতিতে সুদূর নালিশে গিয়া গড়ায় সে দেশের অপমানেরও শেষ নাই । কিন্তু যাহারা সুদীর্ঘকাল শান্তভাবে সহ্য করে তাহারাই যে অকস্মাৎ একদিন তাহাদের চিরসঞ্চিত নীরব নালিশ অন্তরাজ্জ্বালার সহিত উদগীৰ্ণ করিতে পারে এ কথা সকলেই ভুলিয়া যায়- এমন-কি, তাহারা নিজেরাও পূর্বে হইতে বলিতে পারে না। এইজন্য যখন তাহারা হঠাৎ সামান্য উপলক্ষে ক্ষিপ্ত হইয়া উঠে তখন তাহাদের নিরর্থক আচরণ অত্যন্ত অসংগত বলিয়া বোধ হয়। লোকে ভুলিয়া যায়, বহুকালের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বেদনা অবিচার অবিশ্বাস অপমান হঠাৎ একটা তুচ্ছ মন্ত্র-বলে বিরাট আকার ধারণ করিয়া উঠে। মনে হয়, সে যেন একটা আকস্মিক অতিপ্রাকৃত দৈবসৃষ্টি, কেহ যেন পূর্বে হইতে তাহার জন্য অপেক্ষা করিতে পারে না । কিন্তু তাহা আকস্মিক নহে, অতি দীর্ঘকাল ধরিয়া অতিশয় মন্দগতিতেই প্রাকৃত নিয়মের রাজপথ দিয়া সে চলিয়া আসে, তাহার মীেন দীনভােব দেখিয়া কেহ তাহাকে লক্ষ্য করে না।