পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (পঞ্চম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৭৫৩

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

ԳV)V) r রবীন্দ্র-রচনাবলী ছিল না বলিয়া যে হিন্দুরা জাতিবদ্ধ নহে, সে কথা ঠিক নহে। বৈদিক সময় হইতে পৌরাণিক যুগ পর্যন্ত সুদীর্ঘকাল ধরিয়া শাস্ত্র এবং সংস্কার, আচার এবং অনুশাসন, হিন্দুদিগের জন্য এক বিরাট বিস্তৃত আবাসভবন নির্মাণ করিয়াছে। তাহার সকল কক্ষগুলি সমান নহে, মাঝে মাঝে দেয়াল উঠিয়া তাহার ভিন্ন ভিন্ন বিভাগের মধ্যে যাতায়াতের পথ রুদ্ধ হইয়াছে, কিন্তু তথাপি এই বিপুলতার মধ্যে একটা বৃহৎ ঐক্য আছে। এই অট্টালিকার মধ্যে যাহারা আশ্রয় গ্ৰহণ করিয়াছে তাহারা আন্দেী এক-বংশীয় নহে । দক্ষিণের দ্রাবিড়ি হইতে হিমালয়ের নেপালি পর্যন্ত নানা বিচিত্র জাতি বহুকালে ক্ৰমে ক্ৰমে ইহার মধ্যে সম্মিলিত হইয়াছে । বরঞ্চ যে-সকল জাতি মিশ্রিত হইয়া ইংরাজ-মহাজাতি রচিত হইয়াছে তাহারা মূলত ভিন্নগোত্রীয় নহে। কিন্তু হিন্দুদের মধ্যে বিসদৃশ-জাতি-পরম্পরা যেমন একত্র মিশ্রিত হইয়াছে জগতে এমন আর কুত্ৰাপি ঘটে নাই । স্পেক্টেটর যে স্বাভাবিক পরজাতিবিদ্বেষের কথা বলিয়াছেন আদিম আৰ্যদের মধ্যে তাহা প্রচুরপরিমাণেই ছিল। আদানপ্রদান আচার বিচার, এমন-কি, জ্ঞানবিজ্ঞানচর্চায় তাহারা আপনাদিগকে অনার্যদের সংস্রব হইতে দূরে রক্ষা করিবার জন্য একান্ত চেষ্টা করিয়াছিলেন । এ এক বহুদিনব্যাপী প্ৰকাণ্ড যুদ্ধ। রামায়ণ-মহাভারতের সুবিশাল ছন্দঃস্রোতের মধ্যে এই প্রাণপণ যুদ্ধের প্রলয়কল্লোল এখনো ধ্বনিত হইতেছে। কিন্তু চারি দিকের সহিত চিরকাল লড়াই করা চলে না | ক্রমে বিরোধচেষ্টা শিথিল হইয়া আসে এবং অল্পে অল্পে সন্ধি স্থাপিত হয় । এবং এইরূপে ধীরে ধীরে আর্য-অনার্যের মাঝখানের ব্যবধান ক্ষীয়মাণ হইয়া আসিল এবং ক্রমে অনার্যদের সংস্কার, তাহাদের পূজাবিধি, তাহাদের দেবতা অভিমানী আর্যাবর্তের মধ্যে প্রবেশ করিয়া তাহাকে আবর্তিত করিয়া তুলিল । সেইজন্যই আজ হিন্দুজাতি জ্ঞানে অজ্ঞানে, আচারে অনাচারে, বিবেকে এবং অন্ধ কুসংস্কারে এমন একটা অদ্ভুত মিশ্রণ হইয়া দাড়াইয়াছে। য়দিচ সকল বিষয়েই আর্য-অনার্যের মধ্যবর্তী সীমা বিলুপ্তপ্রায় হইয়া আসিয়াছে, এমন-কি, আমাদের বর্ণ আকার আয়তনে রক্তমিশ্রণেরও সাক্ষ্য দিতেছে, তথাপি স্বাতন্ত্র্যরক্ষণজন্য বহুকালব্যাপী সেই যুদ্ধচেষ্টা আজিও হিন্দুসমাজের আদ্যন্তমধ্যে সজাগ হইয়া আছে। তবে, পূর্বেকার সেই আৰ্য-অনার্যের সংগ্রাম অদ্য হিংস্ৰ উগ্রতা পরিত্যাগ করিয়াছে বটে। কিন্তু তাহা পরিব্যাপ্ত হইয়া সমাজের অঙ্গপ্রত্যঙ্গের মধ্যে বিচ্ছেদ আনয়ন করিয়াছে | তাহার এক কারণ, আমাদের পরস্পরের মধ্যে বৈসাদৃশ্য এত অধিক যে, প্রকৃতির অনিবাৰ্য নিয়মে যখন আমরা মিলিতেছিলাম। তখনো শেষ পর্যন্ত আমাদের স্বাতন্ত্র্যাচেষ্টার বিরাম ছিল না | আকর্ষণ এবং বিপ্রকর্ষণ কেহই সম্পূর্ণ হার মানিতে চাহে নাই । এই কারণে যদিচ আমরা বহুসংখ্যক আর্য অনার্য এবং সংকর জাতি হিন্দুত্ব-নামক এক অপরূপ ঐক্য লাভ করিয়াছি, তথাপি আমরা বল পাই নাই । আমরা যেমন এক তেমনি বিচ্ছিন্ন । এই দুর্বলতার প্রধাণ কারণ, আমরা অভিভূত ভাবে এক, আমরা সচেষ্ট ভাবে এক নাহি। যাহারা আমাদের সহিত সংলগ্ন হইয়াছে, যাহাদিগকে আমরা কিছুতেই খেদাইয়া রাখিতে পারি নাই, আমাদের বেড়া-দেওয়া উদ্যানের মধ্যে যে-সকল আগাছা। আপনি আসিয়া প্ৰবেশ করিয়াছে, তাহারা ক্ৰমে অনবধান অথবা অভ্যাসের জড়ত্ব -বশত আমাদের সহিত এক হইয়া গেছে । দুৰ্ভাগ্যক্রমে তাহারা কী শারীরসংস্থানে কী বুদ্ধিবৃত্তিতে আর্যদের সশ্রেণীয় বা সমকক্ষ নহে। তাহারা সর্ববিষয়েই নিকৃষ্ট । এই কারণে তাহারা আর্যসভ্যতায় বিকার উৎপাদন না করিয়া থাকিতে পারে না । তাহারা যেমন আর্যরক্তের বিশুদ্ধতা নষ্ট করিয়াছে তেমনি আর্যধর্ম আৰ্যসমাজকেও বিকৃত করিয়া দিয়াছে। এই বহু দেবদেবী, বিচিত্র পুরাণ এবং অন্ধলোকাচার -সংকুল আধুনিক বৃহৎ বিকারের নাম হিন্দুত্ব । কিন্তু আমাদের এই বিকারের জন্য তত ক্ষোভ নাই বিচ্ছেদের জন্য যত । এক্ষণে ধর্মে আচারে