পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (পঞ্চম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৭৫৪

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

পরিশিষ্ট vG বিশ্বাসে ও শিক্ষায় ব্ৰাহ্মণ-আব্রাহ্মণের মধ্যে ভেদ ক্ষীণপ্ৰায় হইয়া আসিয়াছে, বহুকালের সংঘর্ষে পরস্পরের মধ্যে অনেক অদলবদল হইয়া আৰ্য অনার্যতার এবং অনার্য আৰ্য্যতার ভাবে এক হইয়া আসিয়াছে। যাহা হইবার তাহা হইয়া গেছে। কিন্তু তবু বিচ্ছেদ ভাঙে না । অর্থাৎ, ঐক্যের যা ক্ষতি তাহাও ঘটিয়াছে এবং অনৈক্যের যা দোষ তাহাও বর্তমান । এক্ষণে এই দুটাই সংশোধন করা আমাদের কাজ। নতুবা আমাদের উন্নতির ভিত্তি দৃঢ় হইবে না । নতুবা আমাদের শিক্ষা মিথ্যা, আমাদের আন্দোলন নিস্ফল, আমাদের কনগ্রেস কনফারেন্স প্রভৃতি সমস্তই ক্ষণকালের ক্ষীণ উদ্যম । է: এক্ষণে যিনি জড়ীভূত হিন্দুজাতির মধ্যে আচারে ব্যবহারে সমাজে ধর্মে আর্যভাবের একটি বিশুদ্ধ আদর্শ স্থাপন এবং কৃত্ৰিম ক্ষুদ্র নিরর্থক বিচ্ছেদগুলি দূর করিয়া সমগ্ৰ লোকন্তুপের মধ্যে একটি সজীব ঐক্য সঞ্চার করিয়া দিবেন। তিনিই ভারতবর্ষের বর্তমান কালের মহাপুরুষ । পূর্বেই বলিয়াছি, রাষ্ট্ৰতন্ত্রীয় একতা আমাদের ছিল না। শত্রুকে আক্রমণ, শত্রুর আক্রমণ হইতে আত্মরক্ষা এবং এক শাসনতন্ত্রের অধীনে পরস্পরের স্বার্থ ও শুভাশুভের একত্ব অনুভব আমরা কখনো দীর্ঘকাল করি নাই । আমরা চিরদিন খণ্ড খণ্ড দেশে খণ্ড খণ্ড সমাজের সংকীর্ণ প্রাদেশিকতা-দ্বারা বিভক্ত । আমাদের স্থানীয় আচার, স্থানীয় বিধি, স্থানীয় দেবদেবীগণ বাহিরের আক্রমণ ও সংশোধন হইতে নিরাপদভাবে সুরক্ষিত্ত হইয়া এক দিকে ক্ষুদ্র অসংগত, অন্য দিকে প্রবল পরাক্রমশালী হইয়া উঠিয়াছে। আমাদের ভিতরকার অনার্যতা, অদ্ভুত লোকাচার ও অন্ধ সংস্কারে শাখাপল্লবিত হইয়া আমাদিগকে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র, জঙ্গলে পরিবৃত করিয়া রাখিয়াছে, সর্বসাধারণ মানবজাতির রাজপথকে আমাদের নিকট হইতে অবরুদ্ধ করিয়াছে। আমরা প্ৰাদেশিক, আমরা পল্লীবাসী ; বৃহৎ দেশ ও বৃহৎ সমাজের উপযোগী মতের উপারতা, প্রথার যুক্তিসংগতি এবং সাধারণ স্বার্থরক্ষার উদযোগপরতা আমাদের মধ্যে নাই | এক কথায় বৃহৎক্ষেত্রে জীবনযাত্ৰা নির্বাহ করিবার যে সফলতা তাহা আমরা লাভ করিতে পারি নাই । এক্ষণে ইংরাজ রাজত্বে আমরা পরস্পর নিকটবতী হইয়াছি । এক্ষণে আমাদের প্রাদেশিক বিচ্ছেদগুলি ভাঙিয়া ফেলিবার সময় হইয়াছে । বহুদিনের বিরোধ-দ্বন্দ্বের মধ্যে যে-একটি প্রাচীন ঐক্যগ্রন্থি আমাদের নাড়িতে নাড়িতে বাধিয়া গিয়াছে সেইটোকেই প্ৰবল করিয়া আমাদের স্থানীয় এবং বর্তমান কালে হিন্দুয়ানির পুনরা থানের যে-একটা হাওয়া উঠিয়াছে তাহাতে সর্বপ্রথমে ঐ অনৈক্যের ধুলা, সেই প্রাদেশিক ও ক্ষণিক তুচ্চতাগুলিই উড়িয়া আসিয়া আমাদিগকে আচ্ছন্ন করিয়াছে। কারণ, সেইটেই সর্বাপেক্ষা লঘু, এবং সেইটেই অল্প ফুৎকারে আকাশ পরিপূর্ণ করিয়া তুলিতে পারে । কিন্তু এ ধূলা কাটিয়া যাইবে, আমাদের নিশ্বাসবায়ু বিশুদ্ধ হইবে, আমাদের চারি দিকের দৃশ্য উদঘাটিত হইবে— সন্দেহমাত্র নাই; আমাদের দেশের যাহা স্থায়ী, যাহা সারবান, যাহা গভীর, যাহা আমাদের সকলের ঐক্যবন্ধনের উপায়, তাহাই ক্ৰমে প্রকাশিত হইয়া পড়িবে | যখন কোনো প্রবল সংঘর্ষে কোনো নূতন শিক্ষায় একটা জাতি জাগ্রত হইয়া উঠে, তখন সে নিজেরই মধ্যে শক্তি সন্ধান করে । সো জানে যে, ধার করিয়া চলে না। যদি পৈতৃক ভাণ্ডারে মূলধন থাকে। তবেই বৃহৎ বাণিজ্য এবং লক্ষ্মীলাভ, নতুবা চিরদিন উদ্ধৃবৃত্তি । আমাদের সংস্কার ও শিক্ষা এত দীর্ঘকালের, তাহা আমাদিগকে এমন জটিল বিচিত্র ও সুদৃঢ় ভাবে জড়িত করিয়া রাখিয়াছে যে, বৃহৎ জাতিকে চিরকালের মতো তাহার বাহিরে লইয়া যাওয়া কাহারও সাধ্যায়ত্ত নহে। সেই চিরোদভিন্ন ভারতািন্বষীয় প্রকৃতির মধ্য হইতেই আমাদের অভ্যুত্থানের উপাদান সংগ্ৰহ করিতে হইবে । আমরা ধুমকেতুর মতো দুই-চারিজন মাত্র গর্ববিস্ফারিতপুচ্ছে লঘুবেগে সাহেবিয়ানার দিকে ছিটকিয়া যাইতে পারি, কিন্তু সমস্ত দেশের পক্ষে তেমন লঘুত্ব সম্ভবপর নহে। ] অতএব এক দিকে আমাদের দেশীয়তা, অপর দিকে আমাদের বন্ধনমুক্তি, উভয়ই আমাদের পরিত্রাণের পক্ষে অত্যাবশ্যক। সাহেবি অনুকরণ আমাদের পক্ষে নিস্ফল এবং হিন্দুয়ানির গোড়ামি