পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (পঞ্চম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৭৬২

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

পরিশিষ্ট Գ8Ç দোষে জন্মিতেই পারে না। তবে কেন এমনতরো ঘটে। নিশ্চয়ই কোনো-একটা কুমন্ত্রী আছে। বাস। ইংরাজের বুদ্ধিতে সমস্তই পরিষ্কার হইয়া গেল । এই মূঢ় অন্ধতা যদি কেবলমাত্র ইংরাজ সম্পাদকদের মধ্যে বদ্ধ থাকিত তাহা হইলেও আমরা অনেকটা নিশ্চিন্ত থাকিতে পারিতাম। কিন্তু পূর্বেই বলিয়াছি, আজকাল ইংরাজ সম্পাদকের আসন হইতে ভারতরাজতত্তা পর্যন্ত একটা সমভূমিতার লক্ষণ দেখা যাইতেছে। বােম্বায়ের দুর্ঘটনাবলীতে দেখা গিয়াছে, বােম্বাই-কর্তৃপক্ষদিগের মেজাজ টাইমস অফ ইন্ডিয়া'র মেজাজ হইতে বড়ো তফাত নয়। তেমনি উদ্ধত অবিবেচনা, অবজ্ঞাপূর্ণ কঠোরতা, দেশীয় লোকের গভীরতম বেদনা এবং করুণতম আবেদনের প্রতি নিরতিশয় উপেক্ষা। তা ছাড়া, দেশীয় লোকদের ব্যবহারে যদি কোনোপ্রকার অসন্তোষের লক্ষণ দেখা যায়। সেজন্য তাহারাই একমাত্র দোষী, গবর্মেন্টও এই প্রকারের একটা আরামদায়ক মূঢ় সিদ্ধান্ত অবলম্বন করিয়াছেন। ইংরাজ, সে সামান্য সৈন্যই হউক বা জিলার কর্তাই হউন, কখনাে দােষী হইতে পারে না, তাহাদের আচরণে পীড়া অনুভব করাই পীড়িতের পক্ষে বেয়াদবি ; তাহাদের দুর্ব্যবহারের সকল কথাই মিথ্যা ; অতএব নিশ্চয়ই ইহার মধ্যে কুমন্ত্রী আছে। অতএব ধরো নাটু-ভাইদুটােকে । দাও তিলককে জেলে । দেশী সম্পাদকগুলাকে এক-একটা তৃণের মতো উৎপাটন করিয়া আনো। কুমন্ত্রী থাকিতেই হইবে, কারণ, ইংরাজ অতিশয় প্রিয়চারী, ভারি এমিয়েবল । এ-সমস্ত, ফলাফলবিচারী ধৈর্যশীল গবর্মেন্টের মতো ব্যবহার নাহে ; এ ঠিক দৈনিক ইংরাজি কাগজের দ্রুতলিখিত গরম গরম বঁঝালো প্ৰবন্ধকে ইতিহাসে প্ৰতিফলিত করা । মনে হয় যেন দায়িত্ববিহীন বেসরকারি ইংরাজ-সমাজের উদবেলিত অসহিষ্ণুতা গবর্মেন্টকেও অত্যন্ত অদ্ভুত এবং অশোভন রূপে চঞ্চল করিয়া তুলিয়াছে। গবর্মেন্টের এই সমস্ত আধুনিক লক্ষণ দেখিয়া আমাদের মনে আশঙ্কা হয়। লর্ড ক্যানিং প্রভৃতি মনস্বী রাজনীতিজ্ঞগণের গবর্মেন্ট সমুদ্রতীরে শৈলতােটর মতো উদার অটল এবং ক্ষমাশীল ছিল । তাহাদের সময়ে ঝড় কম যায় নাই, এবং তরঙ্গিত ইংরাজসমাজ দেশটাকে স্থা করিয়া গিলিবার জন্য উদ্যত হইয়াছিল ; তখন উন্নত কঠিন গবমেন্ট তাহাদিগকে ঠেকাইয়াছিল। মনে হইতেছে, যেন কালক্রমে সেই উন্নত তীর অল্পে অল্পে ক্ষইয়া আসিতেছে, জলের সহিত সমতল হইতেছে ; ঝড়-ঝাপটের দিনে তুফানকে অটলভাবে ঠেকাইয়া রাখিবার ক্ষমতা তাহার চলিয়া যাইতেছে। অথচ ফুৎকারমাত্রেই তুফান উঠিয়া পড়ে এবং কেন-যে এই সমুদ্র সর্বদাই ফেনিল বিচলিত হইয়া উঠিতেছেন তাহার রহস্য জলবায়ুতত্ত্বের রহস্যের মতোই দুর্বোিধ । আসল কথা, ভারতবষীয় ইংরাজসম্প্রদায়ের মধ্যে সামাজিকতার ঘনিষ্ঠতা উত্তরোত্তর বাড়িয়া চলিয়াছে। সিমলা দাৰ্জিলিং নৈনিতাল নীলগিরি জাকিয়া উঠিতেছে। ভারতবর্ষে পূর্বাপেক্ষা ইংরাজ নারীদের প্রাদুর্ভাব বেশি হওয়াতে তাহার দুইটি ফল দেখা যায়- প্রথমত দেশীয়দের সহিত ব্যবধান দৃঢ়তর, দ্বিতীয়ত নিজেদের মধ্যে বন্ধন ঘনিষ্ঠতর হইয়াছে। কাজকর্ম কোনােমতে সারিয়া ফেলিয়া আপনাদের সেই মণ্ডলীর মধ্যে ঢুকিয়া পড়িবার প্রলোভন স্বাভাবিক। সেই মণ্ডলীর সহিত অবশিষ্ট ভারতবর্ষের প্রভেদ। ইংরাজের কাছে অত্যন্ত অধিক এবং অরুচিকর । । এই কারণে ভারতবর্ষের সহিত ইংরাজের সম্পর্ক উত্তরোত্তর তেলে-জলের মতো হইতেছে। এবং নিজেরাই আপনাদের সুখ সাত্ত্বনা-আরামের একমাত্র উপায় হওয়াতে পরস্পরের নিকট পরস্পরের গৌরব অতিশয় বাড়িয়া উঠিতেছে। এরূপ কুটুম্বিতা যখন স্বাভাবিক তখন ইহার বিরুদ্ধে কোনো কথা বলিবার জো নাই। আমরা কেবল সরকারি ও বেসরকারি ইংরাজ কেমন করিয়া একাকার হইয়া আসিতেছে তাহার কারণ নির্ণয় করিতেছি মাত্র । , এখন যে-কোনাে বিধান বা রাজনীতির ভারতবষীয় ইংরাজী-সাধারণের অপ্রিয় তাহাতে হাত দিতে