পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (পঞ্চম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৭৯০

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

পরিশিষ্ট AAS) এবারে কিন্তু দুর্বল ভীরুর স্বভাবসিদ্ধ ছলাকলা বিশেষ দেখা যায় নাই- প্ৰজ্ঞ প্ৰবীণ ব্যক্তিরাও একেবারে হাল ছাড়িয়া দিয়া সোজা সোজা কথা কহিয়াছেন । ইহার কারণ এই যে দুটাে ব্যাপার লইয়া আলোচনা উপস্থিত হইয়াছে সে দুটােই আমাদের মনে গোড়াতেই একটা অবিশ্বাস জন্মাইয়া দিয়াছে। এ দুটাে ব্যাপারের ভিত্তিই অবিশ্বাস । এই অবিশ্বাসের যথার্থ হেতু আছে কি না-আছে তাহা লইয়া তর্ক করা মিথ্যা- কারণ, চাণক্য স্পষ্ট ভাষায় বলিয়াছেন, স্ত্রীলোক এবং রাজা উভয়ের মনস্তত্ত্ব সাধারণ লোকের পক্ষে দূরজ্ঞেয়। এবং যাহা দুরজ্ঞেয় আত্মরক্ষার জন্য দুর্বল লোকে তাহাকে গোড়াতেই অবিশ্বাস করিয়া থাকে, ইহা স্বাভাবিক । বর্তমান আন্দোলনে আমরা এই কথা বলিয়া আরম্ভ করিয়াছি যে, য়ুনিভার্সিটি বিলের দ্বারা তোমরা এ দেশের উচ্চশিক্ষা, স্বাধীন শিক্ষার মূলোচ্ছেদ করিতে চাও, এবং বাংলাকে দ্বিখণ্ডিত করিয়া তোমরা বাঙালিজাতিকে দুর্বল করিতে ইচ্ছা কর । শিক্ষা এবং ঐক্য, এই দুটাই জাতিমাত্রেরই আত্মোন্নতি ও আত্মরক্ষার চরম সম্বল। এই দুটার প্রতি ঘা পড়িয়াছে এমন যদি সন্দেহমাত্ৰ মনে জন্মায়, তবে ব্যাকুল হইয়া উঠিবার কথা। বিশেষত যখন মনে জানি- অপর পক্ষ বলিষ্ঠ, আমাদের হাতে কোনো উপায় নাই, এবং যাহারা আমাদিগকে আঘাত করিতে উদ্যত হইয়াছেন তাহাদিগকেই আমাদের সহায় ও সখা বলিয়া আহবান করিতে হইবে । কিন্তু বর্তমান ঘটনায় আমাদের কাছে সব চেয়ে আশ্চর্যের বিষয় এই মনে হয় যে, আমরা অবিশ্বাস প্রকাশ করিয়াছি, কিন্তু বিশ্বাসের বন্ধন ছেদন করিতে পারি নাই। ইহাকেই বলে ওরিয়েন্টালএইখানেই পাশ্চাত্যদের সঙ্গে আমাদের প্রভেদ । যুরোপ কায়মনোবাক্যে অবিশ্বাস করিতে জানে । আমরা ক্ষণকালের জন্য রাগ করি আর যাই করি, অন্তরের মধ্যে আমরা পুরাপুরি অবিশ্বাস করিতে পারি না । ষোলো-আনা অবিশ্বাসকে জাগাইয়া রাখিবার যে শক্তি তাহা আমাদের নাই- আমরা ভুলিতে চাই, আমরা বিশ্বাস করিতে পারিলে বাচি । আমি জানি, আমার একজন বাঙালি বন্ধুর বিরুদ্ধে কোনো ইংরাজ মিথ্যা চক্রান্ত করিয়াছিল। সেই মিথ্যা যখন প্রমাণ হইয়া গেল তখন তাহাকে তাহার এক ইংরাজ সুহৃদ বলিয়াছিলেন : Spare him not.crush him like a worm ! কিন্তু বাঙালি সে সুযোগ সম্পূর্ণ গ্রহণ করিতে কুষ্ঠিত হইয়াছিলেন এবং তাহার ফল এখনো ভোগ করিতেছেন । নিঃশেষে দালন করিতে, নিঃশেষে অবিশ্বাস করিতে, নিঃশেষে চুকাইয়া ফেলিতে আমরা জানি না- আমাদের চিরন্তন প্রকৃতি এবং শিক্ষা আমাদিগকে বাধা দেয়- এক জায়গায় আমাদের মন বলিয়া ওঠে, “আহা, আর কেন, আর কাজ নাই, আর থাক ৷” পরিপূর্ণ অবিশ্বাসের মধ্যে যে একটা কাঠিন্য, যে একটা নির্দয়তা আছে, আমাদের গাৰ্হস্থ্যপ্রধান, আমাদের মিলনমূলক সভ্যতা তাহা আমাদিগকে চর্চা করিতে দেয় নাই। সম্বন্ধবিস্তার করিবার জন্যই আমরা সর্বতোভাবে চিরদিন প্ৰস্তুত হইয়াছি, সম্বন্ধবিচ্ছেদ করিবার জন্য নহে। যাহা অনাবশ্যক । তাহাকেও রক্ষা করিবার, যাহা প্রতিকূল তাহাকেও অঙ্গীভূত করিবার চেষ্টা করিয়াছি। কোনো জিনিসকেই ঝাড়ে-মূলে উপড়াইয়া একেবারে টান মারিয়া ফেলিয়া দিতে শিখি নাই- আত্মরক্ষার পক্ষে, স্বাস্থ্যরক্ষার পক্ষে ইহা সুশিক্ষা নহে। য়ুরোপ যাহা-কিছু পাইয়াছে তাহা বিদ্রোহ করিয়া পাইয়াছে, আমাদের যাহা-কিছু সম্পত্তি তাহা বিশ্বাসের ধন । এখন, বিদ্রোহপরায়ণ জাতির সহিত বিশ্বাস্যপরায়ণ জাতির বোঝাপড়া মুশকিল হইয়াছে। স্বভাববিদ্রোহী স্বভাববিশ্বাসীকে শ্রদ্ধা করে না । চাণক্যপণ্ডিতের স্ত্রীয়ু রাজকুলেষু চ শ্লোক বাঙালির কণ্ঠস্থ কিন্তু বাঙালির তদপেক্ষা কণ্ঠালগ্ন তাহার স্ত্রী । সেজন্য তাহাকে দোষ দেওয়া যায় না ; কারণ, শুষ্ক পুঁথির চেয়ে সরস রক্তমাংসের প্রমাণ ঢের বেশি আদরণীয়। কিন্তু রাজকুল সম্বন্ধে চিন্তা করিয়া দেখিলে বিস্মিত হইতে হয়। হাতে-হাতেই তাহার यूछेलु एनाथो যদি সত্যই তোমার এই ধারণা হইয়া থাকে যে, বাঙালিজাতিকে দুর্বল করিবার উদ্দেশেই বাংলাদেশকে খণ্ডিত করা হইতেছে- যদি সত্যই তোমার বিশ্বাস যে, য়ুনিভার্সিটি-বিলের দ্বারা