পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (পঞ্চম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৭৯২

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

পরিশিষ্ট ዓዓ¢ আমাদের নিজের দিকে যদি সম্পূর্ণ ফিরিয়া দাড়াইতে পারি, তবে নৈরাশ্যের লেশমাত্র কারণ দেখি না। বাহিরের কিছুতে আমাদিগকে বিচ্ছিন্ন করবে। এ কথা আমরা কোনোমতেই স্বীকার করিব না। বিচ্ছেদের চেষ্টাতেই আমাদের ঐক্যানুভূতি দ্বিগুণ করিয়া তুলিবে। পূর্বে জড়ভাবে আমরা একত্র ছিলাম, এখন সচেতনভাবে আমরা এক হইব । বাহিরের শক্তি যদি প্রতিকূল হয়, তবেই প্রেমের শক্তি জাগ্রত হইয়া উঠিয়া প্রতিকারচেষ্টায় প্রবৃত্ত হইবে। সেই চেষ্টাই আমাদের যথার্থ লাভ। কৃত্রিম বিচ্ছেদ । যখন মাঝখানে আসিয়া দাড়াইবে তখনই আন্তরিক ঐক্য উদবোল হইয়া উঠিবে- তখনই আমরা যথার্থভাবে অনুভব করিব যে, বাংলার পূর্বপশ্চিমকে চিরকাল একই জাহ্নবী তাহার বহু বাহুপাশে বঁধিয়াছেন, একই ব্ৰহ্মপুত্র তাহার প্রসারিত ক্ৰোড়ে ধারণ করিয়াছেন ; এই পূর্বপশ্চিম, হৃৎপিণ্ডের দক্ষিণ বাম অংশের ন্যায় একই সনাতন রক্তস্রোতে সমস্ত বঙ্গদেশের শিরা-উপশিরায় প্ৰাণবিধান করিয়া আসিয়াছে। আমাদিগকে কিছুতে পৃথক করিতে পারে এ ভয় যদি আমাদের জন্মে, তবে সে ভয়ের কারণ নিশ্চয়ই আমাদেরই মধ্যে আছে এবং তাহার প্রতিকার আমাদের নিজের চেষ্টা ছাড়া আর-কোনো কৃত্রিম উপায়ের দ্বারা হইতে পারে না। এখন হইতে সর্বতোভাবে সেই শঙ্কার । কারণগুলিকে দূর করিতে হইবে, ঐক্যকে দৃঢ় করিতে হইবে, সুখে-দুঃখে নিজেদের মধ্যেই মিলন প্ৰতিষ্ঠা করিতে হইবে । এ হইল প্ৰাণের কথা ; ইহার মধ্যে সুবিধা-অসুবিধার কথা, লাভক্ষতির কথা যদি কিছু থাকেযদি এমন সন্দেহ মনে জন্মিয়া থাকে যে, বঙ্গবিভাগসূত্রে ক্রমে ‘চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত’ লোপ পাইতে পারে, আমাদের চাকরি-বাকরির ক্ষেত্র সংকীর্ণ হইতে পারে- তবে সে সম্বন্ধে আমাদের বক্তব্য এই যে, পারে বটে, কিন্তু কী করিবে। কর্তৃপক্ষ যদি মনে মনে একটা পলিসি আঁটিয়া থাকেন, তবে আজ হউক কাল হউক, গোপনে হউক প্রকাশ্যে হউক, সেটা তাহারা সাধন করিবেনই ; আমাদের তর্ক শুনিয়া তাহারা ক্ষান্ত হইবেন কেন । মনে করো-না কেন, কথামালার বাঘ যখন মেষশাবককে খাইতে ইচ্ছা! করিয়া বলিল “তুই আমার জল ঘোলা করিতেছিস, তোকে মারিব তখন মেষশাবক বাঘকে তর্কে কী করিয়া ।” তর্কে বাঘ পরাস্ত হইল, কিন্তু মেষশিশুর কি তাহাতে কোনো সুবিধা হইয়াছিল। অনুগ্রহই যেখানে অধিকারের নির্ভর সেখানে মমতা বাড়িতে দেওয়া কিছু নয়। মূনিসিপালিটির স্বায়ত্তশাসন এক রাজপ্রতিনিধি আমাদিগকে দিয়াছিলেন, আর-এক রাজপ্রতিনিধি তাহা স্বচ্ছন্দে কাড়িয়া লইলেন। উপরন্তু গাল দিলেন, বলিলেন “তোমরা কোনো কর্মের নও'। আমরা হাহাকার করিয়া মরিলাম, “আমাদের অধিকার গেল ।” অধিকার কিসের । এ মোহ কেন । মহারানী এক সময়ে আমাদের একটা আশ্বাসপত্ৰ দিয়াছিলেন যে যোগ্যতা দেখাইতে পারিলে আমরাও রাজকাৰ্যে প্ৰবেশলাভ করিতে পারিব, কালো চামড়ার অপরাধ গণ্য হইবে না। আজ যদি কৰ্মশালা হইতে বহিষ্কৃত হইতে থাকি তবে সেই পুরাতন দলিলটির দােহাই পাড়িয়া লাভ কী। সেই দলিলের কথা কি রাজপুরুষের অগোচর আছে। ময়দানে মহারানীর প্রস্তরমূর্তি কি তাহাতে বিচলিত হইবে। চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত আজও স্থায়ী আছে, সে কি আমাদের অধিকারের জোরে না। রাজার অনুগ্রহে। যদি পরে এমন কথা উঠে যে, কোনো বন্দোবস্তই স্থায়ী হইতে পারে না, শাসনকার্যের সুবিধার উপরেই স্থায়িত্বের নির্ভর, তবে সত্যরক্ষার জন্য লর্ড কর্নওআলিসের প্রেতাত্মকে কলিকাতা টাউন-হল হইতে উদবেজিত করিয়া লাভ কী হইবে । এ-সমস্ত মোহ আমাদিগকে ছিন্ন করিতে হইবে, তবে আমরা মুক্ত হইব । নতুবা প্রতিদিনই পুনঃপুন বিলাপের আর অন্ত থাকিবে না। - কিন্তু যেখানে আমাদের নিজের জোর আছে সেখানে আমরা দৃঢ় হইব । যেখানে কর্তব্য আমাদেরই সেখানে আমরা সচেতন থাকিব । যেখানে আমাদের আত্মীয় আছে সেইখানে আমরা নির্ভর স্থাপন করিব । আমরা কোনোমতেই নিরানন্দ নিরাশ্বাস হইব না । এ কথা কোনোমতেই বলিব না যে, গবর্মেন্টু একটা কী করিলেন বা না করিলেন বলিয়াই অমনি আমাদের সকল দিকে সর্বনাশ হইয়া গেল- তাহাই যদি হওয়া সম্ভবপর হইতে পারে তবে কোনো কৌশললন্ধ সুযোগে, কোনো ভিক্ষালব্ধ