পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (পঞ্চম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৭৯৫

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

AbrO রবীন্দ্র-রচনাবলী ভারতবর্ষের এত দাম, অতএব ঐখানে আমাদের একটা শক্তি আছে। আমাদের অস্ত্রশস্ত্ৰ নাই, কিন্তু যদি আমরা এক হইয়া বলিতে পারি যে, বরং কষ্ট সহিব তবু তোমাদের জিনিস আমরা কিনিব না, তবে সেখানে তোমাদিগকে হার মানিতে হইবে । * , ইহার অনেক পূর্ব হইতেই স্বদেশী সামগ্ৰী দেশে চালাইবার চেষ্টা ভিতরে ভিতরে নানা স্থানে নানা আকারে দেখা দিতেছিল- সুতরাং ক্ষেত্র কতকটা প্ৰস্তুত ছিল । তাহা না থাকিলে শুদ্ধ কেবল একটা সাময়িক রাগারগির মাথায় এই উদযোগ এমন অভাবনীয় বল পাইয়া উঠিত না। কিন্তু সশস্ত্র ও নিরস্ত্ৰ উভয়প্রকার যুদ্ধেই নিজের শক্তি ও দলবল বিচার করিয়া চলিতে হয় । আস্ফালন করাকেই যুদ্ধ করা বলে না। তা ছাড়া এক মুহুর্তেই ‘যুদ্ধং দেহি’ বলিয়া যে পক্ষ রণক্ষেত্রে গিয়া দাঁড়ায় পরমুহুর্তেই তাহাকে ভঙ্গ দিয়া পালাইবার রাস্তা দেখিতে হয়। আমরা যখন দেশের পোলিটিকাল বক্তৃতাসভায় তাল ঠুকিয়া দাড়াইলাম, বলিলাম ‘এবার আমাদের লড়াই শুরু হইল, তখন আমরা নিজের অস্ত্রশস্ত্র দলবলের কোনো হিসাবই লই নাই । তাহার প্রধান কারণ, আমরা দেশকে যে যতই ভালোবাসি-না কেন, দেশকে ঠিকমতো কেহ কোনোদিন জানি না । চিরদিন আমাদিগকে দুর্বল বলিয়া ঘূণা করিয়া আসাতে আমাদের প্রতিপক্ষ আমাদিগকে প্রথমে বিশেষ কোনো বাধা দেন নাই। মনে করিয়াছিলেন, এ সমস্তই কনগ্রেসি চাল— কেবল মুখের অভিমান, কেবল বাক্যের বড়াই । কিন্তু যখন দেখা গেল, ঠিক কনগ্রেসের মলয়ামারুতহিল্লোল নয়, দুটাে একটা করিয়া লোকসানের দমকা বাড়িয়া উঠিতেছে, তখন অপর পক্ষ হইতে শাসন তাড়নের পালা পুরাদমে আরম্ভ হইল। কিন্তু ইংরেজ আমাদিগকে যতই পর মনে করুক-না কেন, প্রজাদের প্রতি হঠাৎ উৎপাত করিতে ইংরেজ নিজের কাছে নিজে লজ্জিত হয় । এ প্রকার বেআইনি ভূতের কাণ্ড তাহাদের রাষ্ট্রনীতিপ্ৰথাবিরুদ্ধ। অল্পবয়সে অধীন জাতিকে শাসন করিবার জন্য যে-সব ইংরেজ এ দেশে আসে তাহাদের মধ্যে এই ইংরেজি প্রকৃতি বিগড়িয়া যায় এবং অধীন দেশের কর্তৃত্ব ধীরে ধীরে ইংরেজ জাতির মনকে আধিপত্যের নেশায় অভ্যস্ত করিয়া আনিতেছে। তবু আজিও ইংলণ্ডবাসী ইংরেজের মনে আইনের প্রতি একটা সম্রামের ভাব নষ্ট হয় নাই | এই কারণে অত্যন্ত ত্যক্ত হইয়া উঠিলেও ভারত রাজ্যশাসন ব্যাপারে হাঙ্গামার পালা সহজে আরম্ভ হয় না- ইংরেজই তাহাতে বাধা দেয় । এইজন্য ফুলার তাহার দলবল লইয়া একদা পূবর্বঙ্গে যেরূপ বে-ইংরাজি দাপাদাপি শুরু করিয়াছিলেন তাহা ভদ্র ইংরেজ পক্ষের দৃষ্টিতে বড়োই অশোভন হইয়া উঠিয়ছিল। এখানকার ক্ষুদ্র ইংরেজদিগের ঐ একটা ভারি মুশকিল আছে। তাহারা যখন ক্ষাপা হইয়া উঠিয়া আমাদের হাড় গুড়া করিয়া দিতে চায় তখন স্বদেশীয়ের সঙ্গেই তাঁহাদের ঠেলাঠেলি পড়ে। তাহারা বিলক্ষণ জানে, আমাদের উপরে খুব কষিয়া হাত চালাইয়া লইতে কিছুমাত্র বীরত্বের দরকার করে না- কারণ, অল্পে অল্পে আমাদেরই শিল এবং আমাদেরই নোড়া লইয়া আমাদেরই দাতের গোড়া একটি একটি করিয়া ভাঙিয়া দেওয়া হইয়াছে। অতএব তর্জনতাড়ন-ব্যাপারে হাত পাকাইবার এমন সম্পূর্ণ নিরাপদ ক্ষেত্র আমাদের দেশের মতো আর কোথাও নাই। কিন্তু সমুদ্রপরে যে ইংরেজ বাস করিতেছে তাহাদের মধ্যে এখনো সেন্টিমেন্টের প্রভাব ঘোচে নাই, রাশিয়ান কায়দাকে লজ্জা করিবার সংস্কার এখনো তাঁহাদের আছে। । এইজন্য আমাদের মতো অস্ত্ৰহীন সহায়হীনেরা যখন কোনাে একটা মর্মান্তিক আঘাত পাইয়া চাঞ্চল্য প্রকাশ করিতে থাকি, তখন ক্ষুদ্র ইংরেজের মধ্যে হাত-নিসপিস ও দাঁত-কিডুমিড়ের অত্যন্ত প্রাদুর্ভাব হয়- তখন বৃহৎ ইংরেজের অবিচলিত সহিষ্ণুতা ও ঔদার্য তাঁহাদের কাছে অত্যন্ত অসহ্য হইতে থাকে । তাহারা বলে, ওরিয়েন্টালদের সঙ্গে এরকম চাল ঠিক নয়- যেমন অন্ত্রশস্ত্ৰ কড়িয়া লইয়া ইহাদিগকে পৌরুষহীন করা হইয়াছে তেমনি টুটি চাপিয়া ধরিয়া ইহাদিগকে নির্বক ও নিশ্চেষ্টা করিয়া রাখিলে তবে ইহারা নিজের ঠিক জায়গাটা বুঝিতে পরিবে । এই কারণে বৃহৎ ইংরেজকে ভুলাইবার জন্য ক্ষুদ্র ইংরেজকে বিস্তর বাজে চাল চালিতে ও