পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (পঞ্চম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৭৯৬

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

পরিশিষ্ট ዓbr◊ কাপুরুষ৩া অবলম্বন করিতে হয়। এই সমস্ত আধ-মরা লোকদিগকেও মারিবার জন্য মিথ্যা আয়ােজন না করিলে চলে না ; বােয়ার-যুদ্ধের পূর্বে এবং সেই সময়ে যে ভুরি ভূরি মিথ্যা গড়িয়া তোলা হইতেছিল তাহাও ইংরেজের সদবুদ্ধিকে পরাস্ত করিবার জন্য। কিন্তু আমরা যে এমন নিরুপায়, আমাদের সম্বন্ধেও গায়ের জ্বালা মিটাইতে এখানকার ক্ষুদ্র ইংরেজের দলকে যে এত ক্ষুদ্রতা প্রকাশ করিতে ও এত মিথ্যা খাড়া করিয়া তুলিতে হয়, ইহাতে ইংরেজ ইংরেজকে হয়তো ভুলাইতে পারে কিন্তু এ দেশের জনসাধারণের কাছে তাহাদের লজ্জা কিছুমাত্র ঢাকা পড়ে না। ইহাতে তাহাদের কাজ উদ্ধার হইতেও পারে। কিন্তু চিরকালের মতো সম্রম নষ্ট হয় । যাহা হউক, এ-সমস্তই যুদ্ধের চাল। বঙ্গবিভাগের সময় আমরা যখন কঁাদিয়া কাটিয়া কর্তাদের আসন তিলমাত্র নড়াইতে পারিলাম না তখন বয়কটের যুদ্ধ ঘোষণা করিয়া দিলাম ; এই স্পর্ধায় স্থানীয় ইংরেজের রক্ত আমরা যথেষ্ট গরম করিয়া তুলিয়াছি। তখন কি আমরা ঠাহরাইয়াছিলাম যুদ্ধ কেবল শুপুত হইতেই চলবে, অপরপক্ষ শরণা আশ্ৰয় করিবার অভিপ্রায় বুক পাতিয়া দিয়া গড়াইয়া। অপর পক্ষে অস্ত্র ধরিবে না। এ কথা মনে করিয়া যুদ্ধে নামা একটা কৌতুকের ব্যাপার, যদি-না অশ্রুজলে তাহার পরিসমাপ্তি হয়। এখন দেখিতেছি, আমরা সেই আশাই মনে রাখিয়ছিলাম। ইংরেজের ধৈর্যের উপরে, ইংরেজের আইনের উপরেই আমাদের সম্পূর্ণ ভরসা ছিল, নিজের শক্তির উপরে নহে। তাই যদি না হইবে, তবে আইন-রক্ষকদের হাতে আইনের দণ্ড লেশমাত্র বিচলিত হইলেই, সামান্য দুই-একটা মাথা-ফাটাফাটি ঘটিলেই আমরা এমন-ভাব করি কেন, যেন মহাপ্ৰলয় উপস্থিত হইল ? ভাবিয়া দেখো দেখি, ইংরেজের উপরে আমাদের কতখানি শ্রদ্ধা কতখানি ভরসা। জমিয়া উঠিয়াছে যে আমরা ঠিক করিয়া বসিয়াছিলাম যে, আমরা বন্দে মাতরম হাঁকিয়া তাঁহাদের দক্ষিণ হাতে আঘাত করিব। তবু তাহাদের সেই হাতের ন্যায়দণ্ড অন্যায়ের দিকে কিছুমাত্র টলিবে না। কিন্তু এই সত্যটা আমাদের জানা দরকার যে, ন্যায়দণ্ডটা মানুষের হাতেই আছে, এবং ভয় বা রাগ উপস্থিত হইলেই সে হাত টলে। আজ নিম্ন-আদালত হইতে শুরু করিয়া হাইকোর্ট পর্যন্ত স্বদেশী মামলায় ন্যায়ের কাটা যে নানা ডিগ্রির কোণ লইয়া হেলিতেছে, ইহাতে আমরা যতই আশ্চর্য হইতেছি। ততই দেখা যাইতেছে আমরা হিসাবে ভুল করিয়াছিলাম। অবশ্য তর্কে জিতিলেই যদি জিত হইত। তবে এ কথা বলা চলিত যে, রাগদ্বেষের দ্বারা আইনকে টলিতে দেওয়া উচিত নহে, তাহাতে অধৰ্ম হয়, অনিষ্ট হয় ইত্যাদি। এ-সমস্তই সদযুক্তি তাহাতে সন্দেহ নাই। কিন্তু ইহার উপর ভর দিয়া একেবারে দুই চক্ষু বুজিয়া থাকিলে চলে না। যাহা ঘটে, যাহা । ঘটিতে পারে, যাহা স্বভাবসংগত, আমরা দুর্বল বলিয়াই যে আমাদের ভাগ্যে তাহার অন্যথা হইবে বিধাতার উপরে আমাদের এতবড়ো কোনো দাবি নাই। সমস্ত বুঝিয়া, জোয়ার-ভাটা রৌদ্রবৃষ্টি সমস্ত বিচার ও স্বীকার করিয়া লইয়া, যদি আমরা যাত্রা আরম্ভ করি তবে নীেকা লেশমাত্র টলিলেই অমনি যেন একটা অদ্ভুত কাণ্ড ঘটিল বলিয়া একেবারে হতবুদ্ধি হইয়া পড়ি না। : অতএব গোড়ায় একটা সত্য আমাদিগকে মনে রাখিতেই হইবে যে, যে-কোনো কারণেই এবং যে-কোনো উপায়েই হউক ইংরেজের যদি আমরা কোনো ক্ষতি করিতে যাই তবে ইংরেজ তাহার প্রতিকারের চেষ্টা করিবেই এবং সে চেষ্টা আমাদের সুখকর হইবে না। কথাটা নিতান্তই সহজ, কিন্তু স্পষ্টই দেখা যাইতেছে এই সহজ কথাটা আমরা বিচার করি নাই এবং আমরা যখন উচ্চস্বরে নিজের বড়াই করিতেছিলাম তখন ইংরেজের মহত্ত্বের প্রতি উচ্চস্বরে আমাদের অটল শ্রদ্ধা ঘোষণা করিতেছিলাম- ইহাতে আমাদের সুবুদ্ধি অথবা পীেরুষ কোনোটারই প্রমাণ হয় নাই। এই তো দেখিতেছি। যুদ্ধের আরম্ভে আমরা বিপক্ষকে ভুল বুঝিয়েছিলাম, তার পরে আত্মপক্ষকে যে ঠিক বুঝি নাই সে কথাও স্বীকার করিতে হইবে। আজ আমরা সকলেই এই কথা বলিয়া আক্ষেপ করিতেছি যে, ইংরেজ মুসলমানদিগকে গোপনে হিন্দুর বিরুদ্ধে উত্তেজিত করিয়া দিতেছে। কথাটা যদি সত্যই হয় তবে ইংরেজের বিরুদ্ধে রাগ করিব