পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (পঞ্চম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৮০০

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

পরিশিষ্ট ԳԵr@, যে কিছু-একটা করিতেছি, ইহাই পরের কাছে দিনরাত প্রমাণ করিবার জন্য পাচকে পনেরো করিয়া ফলাইয়া কেবলই সাগরপারে টেলিগ্ৰাম করাকেই নিজের একমাত্র কাজ বলিয়া যেন না মনে করি । দেশের এক-একটি জায়গায় এক-একটি মানুষ বিরলে বসিয়া নিজের সমস্ত জীবন দিয়া যে-কোনো একটি কর্মকে গড়িয়া তুলিয়া প্রতিষ্ঠিত করিতে থাকুন- এই আমাদের সাধনা। আমরা কিছুই গড়িয়া তুলিতে পারি না, আমাদের হাতে সমস্তই বিক্ষিপ্ত হইয়া পড়ে, আমরা কর্মের নানা সূত্রকে টানিয়া বাধিয়া রাশ বাগাইয়া নিজের হাতে দৃঢ় করিয়া ধরিতে পারি না- এই কারণেই আমরা কামনা করি, কিন্তু সাধনার বেলা চােখে অন্ধকার দেখিতে থাকি— কেবল সমিতির অধিবেশনে অতি সূক্ষ্ম নিয়মাবলী-রচনা লইয়া আমাদের তর্কবিতর্কের অন্ত থাকে না, কিন্তু নিয়ম খাটাইয়া, বাধা কাটাইয়া সিদ্ধির পথে চলিবার দৃঢ় সংকল্পশক্তি আপনার মধ্যে খুঁজিয়া পাই না। চরিত্রের এই দৈন্য আমাদিগকে ঘুচাইতে হইবে । উত্তেজনার দ্বারা তাহা ঘুচে না- কারণ, উত্তেজনা আড়ম্বরের কঙাল, এবং আড়ম্বর কর্ম নষ্ট করিবার শয়তান । আজ নানা স্থানে নানা কাজ লইয়া আমরা নানা লোকে যদি লাগিয়া থাকি তবেই গড়িয়া তুলিবার অভ্যাস আমাদের পাকা হইতে থাকিবে । এমনি করিয়াই ভিতরে ভিতরে স্বদেশ গড়িয়া উঠিবে এবং স্বরাজগঠনের যথার্থ অবকাশ একদিন উপস্থিত হইবে । তখন সত্য উপকরণ ও প্রকৃত লোকের অভাব কেবলমাত্র কথার জোরে ঢাকিয়া দিবার কোনো প্রয়োজন থাকিবে । N i এ কথা নিশ্চয় জানি, অপমানের ক্ষোভে ব্যর্থ আশার আঘাতে আমাদের আত্মাভিমান জাগিয়া উঠে ; এবং সেই আত্মাভিমান আমাদের আত্মশক্তি-উদবােধনের একটা উপায়। বঙ্গবিভাগের বিরুদ্ধে বাঙালির সকল চেষ্টার নিস্ফলতা যখন সুস্পষ্ট আকারে আমাদের কাছে প্রত্যক্ষগোচর হইল তখন আমাদের অভিমান আলোড়িত হইয়া উঠিল । এই অভিমানের তাড়নায় আমরা নিজেকে প্রবল বলিয়া প্রমাণ করিবার যথাসাধ্য চেষ্টা করিয়াছি। অতএব ইহার মধ্যে যে মঙ্গলটুকু আছে তাহাকে অস্বীকার করিতে পারি না । কিন্তু ইহার মধ্যে বিপদের কথাটা এই যে, অভিমানের সঙ্গে যদি ধৈর্যের দৃঢ়তা না থাকে। তবে পরিণামে তাহা আমাদের দুর্বলতার কারণ হইবে । চরিত্রের জোর থাকিলে অভিমানকে আত্মসাৎ করিয়া আপনার শক্তিকে স্থায়ী ভিত্তির উপরে প্রতিষ্ঠিত করিবার জন্য সংকল্প জন্মে, কারণ, যতক্ষণ শক্তি সত্য হইয়া না উঠে ততক্ষণ অভিমানকে অতিমাত্রায় প্রকাশ করিতে থাকা লজ্জাকর এবং তাহা কেবল ব্যর্থতাই আনয়ন করে । নিজের আবেগের আতিশয্যকে এইরূপ নিম্বফলভাবে অসময়ে প্রকাশ করিয়া বেড়ানো শিশুকেই শোভা পায় । অভিমান যখন বিলম্ব সহিতে না পারে, তখন তাহা কর্মকে তেজ না দিয়া কর্মের অঙ্কুরকে ছারখার করিয়া ফেলে। যেদিন হইতে আমাদের মনে রাগ হইল সেইদিন হইতেই আমরা আকাশ কঁপাইয়া বড়াই করিতে আরম্ভ করিয়াছি, আমরা এ করিব, সে করিব, আমরা ম্যাঞ্চেস্টরের রুটি বন্ধ করিব, লিভারপুলের দুই চক্ষু জলে ভাসাইয়া দিব । অথচ মনে মনে আমাদের ভরসাস্থল কী । ইংরেজেরই আইন, ইংরেজেরই সহিষ্ণুতা । আইন বিচলিত হইলেই আমরা বলি, এ যে মগের মুলুক হইল! মর্লির মুখে লিবারেল নীতির উলটা কথা শুনিলেই আমরা বলি, এ কি পুবের সূর্য পশ্চিমে উঠিল! আমার নিবেদন এই, এমন অবস্থায় অভিমানকে নিজের মধ্যে দমন করিতে হইবে । সেই সংযত অভিমান মনের তলদেশ হইতে আমাদের শক্তির শিকড়ের মধ্যে তেজ সঞ্চার করবে। এতদিন যে-সমস্ত কাজ আমাদের চেষ্টাকে টানিতে পরিত্ব না, সেই সমস্ত কাজে আজ মন দিবার মতো ধৈর্য আমাদের জন্মিবে । কাজের কি অন্ত আছে। আমরা কিছুই কি করিয়াছি। একবার সত্য করিয়া ভাবিয়া দেখো, দেশ আমাদের হইতে কত দূরে, কত সুদূরে। আমাদের ঘর হইতে আঙিনা বিদেশ’। সমস্ত ভারতবর্ষের কথা ভাবিলে তো মাথা ঘুরিয়া যায়- শুদ্ধমাত্র বাংলাদেশের সঙ্গেও আমাদের সম্পর্ক কত ক্ষীণ ! এই বাংলাদেশও জ্ঞানে প্রেমে কর্মে আমাদের প্রত্যেকের হইতে কতই দূরে। ইহার জন্য আমরা কতটুকুই