পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (পঞ্চম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৮০৪

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

পরিশিষ্ট ዓbrሕ গ্রামে ঘরে ঘরে গিয়া সত্যমন্ত্রে দীক্ষিত করিয়া তুলিলে, তবেই সমস্ত দেশের যোগে ঐ কনগ্রেস সত্য হইয়া উঠিবে- সেই দিকে চেষ্টা নিযুক্ত করিলে চেষ্টা সার্থক হইবে। কনগ্রেসকে দিনে দিনে বর্ষে বর্ষে দেশের ভিতর দিয়া সত্য করিয়া তুলিব এই চেষ্টাই কোনো এক পন্থীর হউক । তাহাকে এ বৎসর বা ও বৎসর কোনোরকমে দখল করিয়া বসিব এ চেষ্টা এমন মহৎ চেষ্টা নহে যাহার জন্য দুই ভাইয়ে লড়াই করিয়া কিষ্কিন্ধ্যাকাণ্ডের অভিনয় করা যাইতে পারে । আমাদের পুরাণে একটি যজ্ঞভঙ্গের ইতিহাস আছে। দক্ষ যখন তাহার যজ্ঞে সতী অর্থাৎ সত্যকে অস্বীকার করিয়া মঙ্গলকে অপমানিত করিয়াছিলেন তখনই প্ৰচণ্ড উপদ্রব উপস্থিত হইয়া তাহার যজ্ঞ বিনষ্ট হইয়াছিল। দক্ষ কেবল নিজের দক্ষতার প্রতি অন্ধ-অভিমান-বশত জগতে যে যুগে এবং যে ক্ষেত্রেই সত্যকে এবং শিবকে স্বীকার করা অনাবশ্যক মনে করিয়াছে সেইকালে এবং সেইখনেই কেবল যে কর্ম পণ্ড হইয়াছে তাহা নহে, মহান অনর্থ ঘটিয়াছে। ক্ষমতাশালীর জিদ সত্যকে ক্ষণকালের জন্য নিজীব করিয়া ফেলিতেও পারে। কিন্তু রুদ্রকে কখনোই ঠেকাইতে পারে না। এ কথা ইংরেজ ভুলিয়াছে বলিয়া আমরা অভিযোগ আনিয়াছি, কিন্তু আমরা নিজেও যদি ভুলি, বল ও কলাকৌশলকেই অবলম্বন জ্ঞান করিয়া সত্য ও শিবকে যদি অবমানিত করি, তবে পলয়কে জাগ্রত করিয়া তুলিব তাঁহাতে সন্দেহমাত্র নাই। সত্যকে যদি আমরা রক্ষা করি ও মঙ্গলকে বিশ্বাস করি তবে ধৈর্য শান্তি ও উদারতা আমাদের পক্ষে সহজ হইবে ; তবে বিলম্বে অসহিষ্ণু, পীড়নে ভীত ও পরাজয়ে হতাশ্বাস হইব না ; বুদ্ধির পার্থক্য ও মতের অনৈক্যাকে সহ্য করিব, এবং স্বাধীনতা বা স্বরাজের যথার্থই অধিকার লাভ করিতে পারিব । SVS 8 দেশহিত বঙ্গব্যবচ্ছেদের আঘাতে বাংলাদেশে স্বাদেশিকতার যে উদ্দীপনা জ্বলিয়া উঠিয়াছে তাহা যে অন্য দেশের এ-শ্রেণীয় উদ্দীপনার ঠিক নকল নহে, তাহা যে আমাদের দেশের স্বকীয় প্রকৃতি অনুসারে একটি বিশিষ্টতা লাভ করিয়াছে, এমন কথা আমাদের দেশের কোনো বিখ্যাত ইংরেজি কাগজে পড়িয়ছি। লেখক বলেন যে, আমাদের দেশের এই স্বাদেশিকতার উৎসাহ গভীরতর আধ্যাত্মিক ভাবে পূর্ণ, এইজন্য ইহা একটা ধর্মসাধনার আকার ধারণ করিতেছে। এ কথা নিশ্চয় মনে রাখিতে হইবে যে, আমাদের দেশের কোনো উদযোগ যদি দেশের সর্বসাধারণকে আশ্রয় করিতে চায়। তবে তাহা ধর্মকে অবলম্বন না করিলে কোনোমতেই কৃতকাৰ্য হইবে না। কোনাে দেশব্যাপী সুবিধা, কোনাে রাষ্ট্ৰীয় স্বার্থসাধনের প্রলোভন কোনােদিন আমাদের দেশের সাধারণ লোকের মনে শক্তি সঞ্চার করে নাই । অতএব আমাদের দেশের বর্তমান উদ্দীপনা যদি ধর্মের উদ্দীপনাই হইয়া দাঁড়ায়, দেশের ধর্মবুদ্ধিকে যদি একটা নূতন চৈতন্যে উদবােধিত করিয়া তোলে, তবে তাহা সত্য হইবে, স্থায়ী হইবে, দেশের সর্বত্র ব্যাপ্ত হইবে সন্দেহ নাই । আমাদের বর্তমান আন্দোলন সেই সত্যতা লাভ করিয়াছে অথবা করিবে কি না তাহা নিশ্চয় নিরূপণ করিয়া বলিবার ক্ষমতা আমি রাখি না। এইটুকু বলা যায় যে, দেশে যদি দুই-চারিজন মহাত্মাও এই আন্দোলনকে শিক্ষিতসম্প্রদায়ের পোলিটিকাল চাঞ্চল্যমাত্র বলিয়া অনুভব না করেন- তাহারা যদি ইহার নিগুঢ় কেন্দ্ৰস্থলে সেই ধর্মের অগ্নিকে প্রত্যক্ষ দেখিয়া থাকেন যে অগ্নি সমস্ত মিথ্যাকে ভিতর হইতে দগ্ধ করিয়া ফেলে, সমস্ত দীনতাকে ভস্মসাৎ করিয়া দেয় এবং আমাদের যাহা-কিছু শ্ৰেষ্ঠ ও মহামূল্য তাঁহাকেই তপ্ত সুবর্ণের মতো উজ্জ্বল করিয়া তোলে- তবে তঁহাদের সেই উপলব্ধি ও সাধনা নিশ্চয়ই নানাপ্রকার সাময়িক বিক্ষিপ্ততাকে ব্যর্থ করিয়া চরম সফলতা আনয়ন করিবে ।