পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (পঞ্চম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৮০৫

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

ዓሕO রবীন্দ্র-রচনাবলী কিন্তু আমরা যে এই ধর্মের মূর্তিকে দেখিতে পাইয়াছি তাহার প্রমাণ কিসে পাওয়া যাইবে ? যে ইহাকে দেখিয়াছে সে তো আর উদাসীন থাকিতে পারে না। সে একান্ত উদবেগ একান্ত সতর্কতার সহিত ইহাকে রক্ষা করিবার জন্য জাগ্ৰত থাকে- কোনো ভ্ৰষ্টতা কোনো ত্রুটি সে সহ্য করিতে পারে না । সেই প্ৰাণান্তিক সতর্কতা যদি দেখিতে না পাই, যদি দেখি উপস্থিত কোনো উদ্দেশ্যসাধনের কৃপণতায় আমাদের দুর্বল চিত্তকে এমনি অভিভূত করে যে আমাদের সাধনার কেন্দ্ৰস্থিত ধর্মকে সর্বতোভাবে রক্ষা করার গুরুত্ব আমরা বিস্মৃত হই, তবে ইহার মতো উৎকণ্ঠার বিষয় আর কিছুই হইতে পারে না। রাজার সন্দেহ জাগ্রত হইয়া আমাদের চারি দিকে যে শাসনজাল বিস্তার করিতেছে তাহার বিরুদ্ধে আমাদের অভিযোগ আমরা সর্বদা উচ্চকণ্ঠেই প্ৰকাশ করিতেছি, কিন্তু যেখানে আমাদের স্বদেশের লোক আমাদের যজ্ঞের পবিত্ৰ হুতাশনে পাপ-পদার্থ নিক্ষেপ করিয়া আমাদের হোমকে নষ্ট করিতেছে, তাহাদিগকে আমরা কেন সমস্ত মনের সহিত ভৎসনা করিবার, তিরস্কৃত করিবার শক্তি অনুভব করিতেছি না। তাহারাই কি আমাদের সকলের চেয়ে ভয়ংকর শত্ৰু নহে। চৈতন্যদেব একদিন বাংলাদেশে প্রেমের ধর্ম প্রচার করিয়াছিলেন । কাম জিনিসটা অতি সহজেই প্রেমের ছদ্মবেশ ধরিয়া দলে ভিড়িয়া পড়ে, এইজন্য চৈতন্য যে কিরূপ একান্ত সতর্ক ছিলেন তাহা র্তাহার অনুগত শিষ্য হরিদাসের প্রতি অত্যন্ত কঠোর ব্যবহারে প্রমাণিত হইয়াছে। ইহাতে বুঝা যায় চৈতন্যের মনে যে প্ৰেমধর্মের আদর্শ ছিল তাহা কত উচ্চ, তাহা কিরূপ নিষ্কলঙ্ক । তাহার কোথাও লেশমাত্র কালিমাপাতের আশঙ্কায় তাহাকে কিরূপ অসহিষ্ণু ও কঠিন করিয়াছিল। নিজের দলের লোকের প্রতি দুর্বল মমতাকে তিনি মনে স্থান দেন নাই- ধর্মের উজ্জ্বলতাকে সর্বতোভাবে রক্ষা করার প্রতিই তাহার একমাত্র লক্ষ্য ছিল । আজ আমরা দেশে যদি শক্তিধর্মকেই প্রচার করিবার জন্য প্রবৃত্ত হইয়া থাকি তবে তাহারও কি কোথাও বিপদের কোনো সম্ভাবনা নাই। সে বিপদ কি কেবলই যাহাদিগকে আমরা শত্রুপক্ষ বলিয়া জানি তাহদেরই নিকট হইতেই । উন্মত্ততা অন্যায় ও অত্যাচার কি শক্তিরই ছদ্মবেশ ধরিয়া তাহার মূলে আঘাত করে না । যথার্থ দুর্বলতাই কি উচ্ছঙ্খলতার আকার ধারণ করিয়া প্রবলতার ভান করে না। যাহা শক্তি নহে। কিন্তু শান্তির বিড়ম্বনা, শক্তিধর্মসাধনায় তাহার মতো সর্বনেশে বিঘ্ন আর তো কিছুই নাই। বর্তমানে আমাদের দেশে তাহার অভ্যুদয়ের লক্ষণ চারি দিকে দেখা যাইতেছে, কিন্তু আমাদের মধ্যে যাহারা তাহাকে স্পষ্টত প্রশ্রয় দিতেছেন না। তাহারাও তাহাকে ক্ষমাহীন কঠোর শাসন ও ভৎসনার দ্বারা দূরে ঠেকাইয়া রাখিবার চেষ্টা করিতেছেন না। যে শক্তি ধর্ম, তিনি যদি আমাদের স্পষ্ট উপলব্ধিগোচর হইতেন তবে তাহার এই সকল নকল উৎপাতকে কখনো এক দণ্ডের জন্যও সহ্য করিতে পারিতাম না। আজ দস্যবৃত্তি, তস্করতা, অন্যায় পীড়ন, দেশহিতের নাম ধরিয়া চারি দিকে সঞ্চরণ করিতেছে, এ কি এক মুহুর্তের জন্য র্তাহারা সহ্য করিতে পারেন র্যাহারা জানেন আত্মাহিত দেশহিত লোকহিত যে-কোনো হিত -সাধনই লক্ষ্য হউক-না কেন, কেবলমাত্র বীর ও ত্যাগী ও তপস্বী তাহার যথার্থ সাধক। জাতির চরিত্রকে নষ্ট করিয়া আমরা জাতিকে গড়িয়া তুলিব এমন ভয়ংকর ভুলকে তিনি কখনােই এক মুহুর্তের জন্যও মনে স্থান দিতে পারেন না। যিনি ধর্মকেই শক্তি বলিয়া আমাদের দেশের সকল অমঙ্গলের মূল কোথায় । যেখানে আমরা বিচ্ছিন্ন। অতএব আমাদের দেশে বহুকে এক করিয়া তোলায় দেশহিতের সাধনা। বহুকে এক করিয়া তুলিতে পারে কে । ধর্ম। প্রয়ােজনের প্রলোভনে ধর্মকে বিসর্জন দিলেই বিশ্বাসের বন্ধন শিথিল হইয়া যায়। যে অধৰ্ম দ্বারা আমরা অন্যকে আঘাত করিতে চাই সেই অধর্মের হাত হইতে আমরা নিজেকে বঁাচাইব কী করিয়া, মিথ্যাকে অন্যায়কে যদি আমরা কোনো কারণেই প্রশ্রয় দিই। তবে আমরা নিজেদের মধ্যেই সন্দেহ বিশ্বাসঘাতকতা ভ্ৰাতৃবিদ্রোহের বীজ বপন করিব- এমন একটি প্ৰদীপকে নিভাইয়া দিব যে আলোকের অভাবে পুত্র মাতাকে আঘাত করিবে, ভাই ভাইয়ের পক্ষে বিভীষিকা হইয়া উঠিবে। যে ছিদ্র দিয়া আমাদের দলের মধ্যে বিশ্বাসহীন চরিত্রহীন ধর্মসংশয়িীগণ অবাধে প্ৰবেশ করিতে পরিবে: