পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (পঞ্চম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৮১৭

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

bro রবীন্দ্র-রচনাবলী । উজ্জ্বলতম আদর্শস্থল করিয়া তুলিয়াছেন- আর যে বঙ্গদেশ তাহার জীবনের রক্তে জীবন পাইয়াছে সে আজ বহুকষ্টে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করিবার উপলক্ষে দুই-চারিবার সামান্য ব্যর্থ চেষ্টা দেখাইয়াই আপনাকে ঋণমুক্ত জ্ঞান করিয়া সম্পূর্ণ আত্মপ্রসাদ লাভ করিয়াছে। “আজি বঙ্কিমচন্দ্রের মৃত্যুর পরেও আমরা সভা ডাকিয়া সাময়িক পত্রে বিলাপসূচক প্ৰবন্ধ প্রকাশ করিয়া আপনার কর্তব্য সাধন করিতে উদ্যত হইয়াছি। তাহার অধিক আর কিছুতে । হস্তক্ষেপ করিতে সাহস হয় না। প্রতিমূর্তি-প্রতিষ্ঠা বা কোনোরূপ স্মরণ-চিহ্ন-স্থাপনের প্রস্তাব করিতে প্ৰবৃত্তি হয় না। পূর্ব অভিজ্ঞতা হইতে জানা গিয়াছে যে চেষ্টা করিয়া অকৃতকাৰ্য হইবার সম্ভাবনা অধিক । উপযুপরি বারংবার অকৃতজ্ঞতা ও অনুৎসাহের পরিচয় দিলে ক্ৰমে আর আত্মসম্রামের লেশমাত্র থাকিবে না, এবং ভবিষ্যতে প্ৰবন্ধ লিখিয়া শোকের আড়ম্বর করিতেও কুষ্ঠিত বোধ করিতে হইবে । “উপকার গ্রহণ করিবার শক্তির সঙ্গে সঙ্গে কৃতজ্ঞতার শক্তিও বাড়িতে থাকে। আমাদের দেশের জাতীয় স্বাস্থ্যের অবস্থা এখনো সেরাপ দাড়ায় নাই যাহাতে আমরা কোনো মহৎ লোকের দৃষ্টান্ত বা কার্য অন্তরের মধ্যে যথার্থরাপে পরিপাক করিয়া লইয়া তাহার ফল উপলব্ধি করিতে পারি। আমাদের কানের কাছে ক্ৰমাগতই বলা আবশ্যক, তোমার এতখানি উপকার করা হইল, তুমি এতটা লাভ করিলে, তোমার এতখানি পথ নিষ্কণ্টক হইল, অমুক তোমার এতবড়ো সুহৃদ । এইরূপে কৃত্রিম উপায়ে মন্থন করিয়া কিঞ্চিৎ কৃতজ্ঞতা হৃদয়ের উপরিভাগে ফেনিল করিয়া তোলা যাইতে পারে, কিন্তু তাহাকে কোনোরূপ স্থায়ী পদার্থে পরিণত করা যাইতে পারে না । মুক্তৃিতকটা বাষ্প বিসর্জন করিয়া কোথাও কোনো চিহ্নমাত্র না। রাখিয়া তাহা হইয়া যায় । “যে দেশের এমন দুরবস্থা সেই দেশেই মহৎ লোকের নিঃস্বাৰ্থ আত্মবিসর্জনের আবশ্যক সর্বাপেক্ষা অধিক । সহায়তা নাই, কৃতজ্ঞতা নাই, অনুকূলতা নাই, কেবল আপনার অন্তরের মুক্তিভূর্ণ ও উপবাসসহিষ্ণু অকাতর অনুরাগ চিরজীবন একাকী বসিয়া কাজ করিয়া “সেইজন্য যে কয়েকটি মহাত্মা আমাদের দেশের কাজে জীবন বিসর্জন করিয়া গিয়াছেন তাহাদিগকে মিশরের বিস্তীর্ণ মরুভূমির মধ্যে গুটিকতক নিঃসঙ্গ পিরামিডের মতো দেখিতে হয়। এই মৃত সমভূমির মধ্যে র্তাহাদের সমুন্নত মহিমা দ্বিগুণ দেদীপ্যমান হয় বটে, কিন্তু সেইসঙ্গে একটি সুবিশাল বিষাদ হৃদয়কে বাষ্পাকুল করিয়া তোলে। হায়, এতবড়ো জীবন যাহার নিকট নিঃশেষে সমাপিত হইয়াছে সে জানিতেও পারিল না। তাহার কী সৌভাগ্য এবং সে চিরদিনের জন্য কতখানি লাভ করিল। “ভাবসম্পদকে আমরা এখনো যথার্থ সম্পদরাপে গণ্য করিতে শিখি নাই। সাহিত্যরস যে আমাদের জীবনের খাদ্যপানীয়ের ন্যায় অত্যাবশ্যক তাহা এখনো আমরা সম্যক অনুভব করি না। বঙ্কিমচন্দ্রের সৃজনী শক্তি মাতৃভাষার সহিত মিশ্রিত হইয়া বাঙালির জীবনের মজার মধ্যে যে প্রবেশ করিয়াছে, বঙ্কিমের প্রতিভা-উৎসের ভাবপ্রস্রবণ হইতে বাঙালি যে নুতন জীবনরস প্রাপ্ত হইয়াছে, বঙ্কিমের আবির্ভাবের পূর্বে যেরূপ ছিল বঙ্কিমের আবির্ভাবের পরে বাঙালির জীবনের গঠনে যে তদপেক্ষা এক নূতন বৈচিত্র্যের সঞ্চার হইয়াছে তাহা এখনো আমরা সম্যক উপলব্ধি করিতে পারি নাই । “এই স্থলে যদি আমি প্রসঙ্গক্রমে বঙ্কিমচন্দ্রের সহিত নিজের জীবনের সম্বন্ধ আলোচনা করি তবে ভরসা করি শ্ৰোতৃগণ আমার সেই প্ৰগলভ্যতাকে অহমিকা জ্ঞান করিয়া অপরাধ লইবেন। না । আজিকার এই শোকের দিনে বঙ্কিমের নিকট কেবল স্বজাতির নহে নিজের নিজের বিশেষ কৃতজ্ঞতাঋণ স্বীকার করিবার জন্য আবেগ উপস্থিত হয় এবং তাহ দমন করা অবশ্যকর্তব্য বলিয়া বোধ করি না ।