পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (পঞ্চম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৮২২

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

গ্রন্থপরিচয় vלצ জীবনের সাহিত্যচর্চার প্রথম গৌরবের দিন। তাহার পরে সেদিন তিনি আমার প্রবন্ধ শ্রবণ করিয়া সমােদরসহকারে আমার বক্তৃতার স্থলে সভাপতি হইতে স্বীকার করিলেন ; সে সৌভাগ্য অন্য লোকের পক্ষে এমন বিরল ছিল এবং সেই সমাদরবােক্য এমন অন্তরের সহিত উচ্চারিত হইয়াছিল যে, আজ তাহা লইয়া সর্বসমক্ষে গর্ব করিলে ভরসা করি সকলে আমাকে মার্জনা করিবেন । কিন্তু সেই পুরস্কার যে র্তাহার হস্ত হইতে আমার শেষ পুরস্কার হইবে তাহা আমি স্বপ্নেও জানিতাম না । সেই সকল উৎসাহবাক্য সাহিত্যুপথযাত্রার মহামূল্য পাথেয়স্বরূপে আমার মুক্তির ভূগুল সারে রক্ষিত হইল : তদপেক্ষ উচ্চতর পুরস্কার আর এ জীবনে প্রত্যাশা রব না ।*** তিনি “সভা করিয়া" বঙ্কিমের জন্য শোক প্রকাশ করিতে অস্বীকৃত হন।** রবীন্দ্রনাথ ১৩০১ সালের জ্যৈষ্ঠ মাসের সাধনায় ‘শোকসভা’ প্ৰবন্ধ লিখিয়া নবীনচন্দ্রের আপত্তির উত্তর দেন । এই প্ৰবন্ধটি বর্তমান খণ্ডের পরিশিষ্টে মুদ্রিত হইল । ‘রাজসিংহ-সমালোচনার (সাধনা, চৈত্র ১৩০০) সূচনায় রবীন্দ্রনাথ লিখিয়াছিলেন— ‘চষা মাঠের মাঝখানে ভাঙা পথ বাহিয়া পালকি চড়িয়া চলিতে চলিতে বঙ্কিমবাবুর নূতন সংস্করণ রাজসিংহ পড়িতেছিলাম । নববসন্তের আতপ্ত মধ্যাহ্নবায়ু উদ্দাম কৌতুহলভরে মাঠের অপর প্রান্ত হইতে হুহুঃ শব্দে ছুটিয়া আসিয়া পালকির মধ্যে প্রবেশ করিয়াই অকস্মাৎ এই অলখ-অঞ্চল-বিরহিত চাপাকানপরিহিত অধ্যয়নরত পুরুষমূর্তি দেখিবামাত্র সুদীর্ঘ নিশ্বাসে অবজ্ঞা ও নৈরাশ্য প্রকাশ পূর্বক পালকির অপর দ্বার দিয়া ক্ষিপ্ৰবেগে নিষ্ক্রমণ করিতেছিল। মাঝে মাঝে যখন গ্রামের নিকটে আসিতেছিলাম আমার গ্রন্থপাঠের সহিত বনের ছায়া, পাখির গান এবং আম্রমুকুলের গন্ধ মিশ্রিত হইতেছিল। অখণ্ড অবসর ছিল— এবং কল্পনাকে বাধা দিবার জন্য না। ছিল জনতা, না ছিল অট্টালিকা, না ছিল অবরুদ্ধ রাজপথের ধুলিমিশ্রিত বিচিত্র কোলাহল । “ছবি অথবা কোনো সুন্দর শিল্পদ্রব্য পাইলে মানুষ সেটিকে হস্ত প্রসারিত করিয়া কিঞ্চিৎ দূরে ধরিয়া গ্ৰীবা হেলাইয়া দেখে- চোখের উপরে যেখানে শতসহস্ৰ জিনিস ভিড় করিয়া আসিয়াছে সেখান হইতে বিচ্ছিন্ন করিয়া লইয়া মাঝখানে অনেকটা ব্যবধান রাখিয়া সেটিকে স্বতন্ত্র সমগ্রভাবে দেখিতে চাহে । সাহিত্যের সুন্দর জিনিসগুলিও তেমনি কিঞ্চিৎ দূরে ধরিয়া দেখিবার যোগ্য । নহিলে আমার মন এবং তাহার সৌন্দর্যের মধ্যে কল্পনাদূতীর ঘন ঘন আনাগোনা করিবার পথ থাকে না । “এইজন্য মাঠের মধ্যে আমার রাজসিংহ পড়িবার বড়ো সুযোগ ঘটিয়াছিল। বইখানি আমার হাতে ছিল বটে-কিন্তু আসল ব্যাপারটি বাধানো গ্রন্থের কালো মলাটের কারাপ্রাচীর লঙ্ঘন ২৪ পৃ ৫৩৮, বর্তমানে যেখানে প্ৰবন্ধ শেষ হইয়াছে তাহার পরেই মুদ্রিত ছিল। ২৫ সভা-শ্ৰাদ্ধ গড়াইতে গড়াইতে এখন ইংরাজের অনুকরণে “শোক-সভা” পর্যন্ত আরম্ভ হইয়াছে। বঙ্কিমবাবুর জন্য “শোক-সভা” হইবে, রবিবাবু শোক-প্রবন্ধ পাঠ করিবেন, তাহার সভাপতিত্ব করিতে আমি আহুত হইয়াছিলাম। আমি উহা অস্বীকার করিয়া লিখিলাম যে, সভা করিয়া কিরূপে শোক করা যায়, আমি হিন্দু তাহা বুঝি না- এ-সকল কথা শুনিয়া রবিবাবু স্বয়ং লিখিলেন যে আমার সভাপতিত্বের ছায়ায় তিনি তাহার শোক-প্ৰবন্ধ উক্ত সভায় পাঠ করিতে চাহেন - “শোক-সভা” সম্বন্ধে আমার উপরি-উক্ত মতের প্রতিবাদ করিয়া রবিবাবুর “সাধনাতে এক প্ৰবন্ধ বাহির হইয়াছিল।. আমাদের শোক কালো ফিতায় দেখাইবার জিনিস নহে। আমাদের শোক বড় নিভৃত ও পবিত্র। উহা সভা করিয়া একটা তামাশার জিনিস করা আমি মহাপাতক মনে করি । । * » --নবীনচন্দ্ৰ সেন, “আমার জীবনী, পঞ্চম ভাগ G|G:S