পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (পঞ্চম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৮২৫

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

brS 8 রবীন্দ্ৰ-রচনাবলী “পাখি তাহার স্বাভাবিক মাতৃ-সংস্কার-বশত একটা পাথরের ডিম পাইলেও আগ্রহসহকারে তা দিতে বসে, তাহাতে তাহার ডিমে তা দিবার স্বাভাবিক ব্যাকুলতানিবৃত্তি হয় বটে, কিন্তু সে তা-দেওয়া হইতে শাবক জন্মে না । উপাসনা করিবার একটা ফল, উপাসনা করিবার স্বাভাবিক আকাঙক্ষা তৃপ্তি করাআর-একটি চরম ফল, র্যাহার উপাসনা করি তাহার আদর্শের দিকে আপনাকে নিয়ত প্রসারিত ' করা । সেই নিয়ত প্রসারণে যেমন আনন্দ তেমনি উন্নতি । অতএব যদি ইহা সত্য হয় যে, মানুষ ঈশ্বরকে মানুষিকতা হইতে সম্পূর্ণরূপে নির্মুক্ত করিয়া দেখিতে পারে না, তবে দ্বিগুণ সতর্কতার সহিত র্তাহাকে এমন-সকল সীমা হইতে বিচ্ছিন্ন করিয়া ধারণ করা উচিত যদদ্বারা তাহার আদর্শ পার্থিব আদর্শের মতো খাটাে হইয়া না যায়। তঁহাকে অসীমস্নেহময় বলিলেও, যদি বা মনে মনে মাতৃস্নেহের সহিত র্তার মেহের তুলনা না করিয়া থাকিতে পারি না, তথাপি আমাদের স্নেহের আদর্শ যতই উৎকর্ষ লাভ করুক স্নেহময় বিশেষণকে অতিক্রম করিতে পারে না । কিন্তু যদি একটা বিশেষ কাহিনীদ্বারা তাহার স্নেহের আদর্শকে বদ্ধ করি, যদি বলি তিনি বনের ব্যাধকে গুজরাটের রাজা করিয়া দিয়াছিলেন, তবে লোকবিশেষের কাছে তাহ আদরণীয় হইতে পারে, কিন্তু অপর লোকের কাছে তাহা অন্যায় পক্ষপাত বলিয়া হেয় হইতে পারে । যে লোক গুজরাটের রাজত্ব চায় দেবতার স্তবপক্ষপাতধর্ম তাহার কাছে রমণীয়, কিন্তু যে তাহাকে চায়। সে জানে সাধনার দ্বারা তাহার অক্ষয় মোহ অন্তরে উপলব্ধি করিতে পারি, রাজত্বে নহে, মকদ্দমা-জয়ে নহে, সাংসারিক উন্নতিতে নহে । অতএব ঈশ্বরকে যদি স্নেহময় বলিয়া জানি, তবে সুখে দুঃখে সম্পদে বিপদে তাহার স্নেহের লাঘব দেখি না। কিন্তু তাহাকে যদি কবিকঙ্কণের চণ্ডী বলিয়া জানি। তবে আমার মনে স্নেহের যে আদর্শ আছে তাহা অপেক্ষাও তীহাকে অনেক মুকুটুম! যদি সেইরূপ কম হরিয়া জানি তথাপি বেশি কৰিয়া ভক্তি কৰি, তবে সে বন্ধ্যা হয় ।” “যুগান্তর (সাধনা, চৈত্র ১৩০১) প্রবন্ধের সূচনায় ‘সমালোচকের কাজ সম্বন্ধে রবীন্দ্রনাথ “যাহারা বালি ধুইয়া হীরা বাহির করে তাহারা অনেক কাল বিস্তর বালি ঘাটিয়া এক টুকরা হীরার সন্ধান পায় । গ্ৰন্থ-সমালোচকের ভাগ্যেও হীরা সহজে মেলে না ; সেইজন্য বহুকাল বিস্তর নীরস এবং নিস্ফল পরিশ্রমের পর যেদিন একখানা যথার্থ গ্ৰন্থ হাতে আসে সেদিন আনন্দবেগে গ্রন্থকারকে মনুমেন্টের উপর তুলিয়া দিয়া জয়জয়কার করিতে ইচ্ছা করে । “কিন্তু সমালোচকের কাজটা এমনি যে, তাহাকে পদে পদে আপন উচ্ছাস সংবরণ করিয়া চলিতে হয়, যখন কৃতজ্ঞচিত্তে নুন খাইতেছি তখনো এই কথা মনে রাখিতে হয় কেবলই গুণ গাহিলে চলিবে না, যদি দোষ থাকে তাহাও গাহিতে হইবে।” । এইরূপ “উচ্ছাস-সংবরণ”-এর দৃষ্টান্ত “আধুনিক সাহিত্যা -আলোচনায় বহু বর্তমান। প্ৰবন্ধগুলির মাসিকপত্রে মুদ্রিত পাঠ হইতে আর-কিছু দৃষ্টান্ত সংকলিত হইল “আমাদের এই সমালোচ্য ['আর্যগাথা'] গ্ৰন্থখানিতে কোনো কোনো গানে ইংরাজি প্রথার ভাষা আমাদের কানে খারাপ লাগিয়াছে। ইংরাজি ভাব গ্ৰহণ করিয়া আমাদের ভাষা ও সাহিত্যকে পরিপুষ্ট করিতে দোষ নাই। কিন্তু এমন অনেকগুলি ভােব আছে যাহা আমাদের পক্ষে নিতান্তই বিদেশী, সেগুলি বাংলায় বর্জনীয় - “চেয়ে না বিরাগে মাখি হিম আঁখি তুলি মোর পানে ইংরাজিতে cold শব্দের সহিত যে-একটি অপ্রিয় ভাবের যোগ আছে বাংলায় তাহা নাই এবং হইতেও পারে না । সেইজন্য হিম আঁখি শব্দটা কানে বিজাতীয় বলিয়া ঠেকে । ইংরাজিতে love