পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (পঞ্চম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৮৩৬

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

গ্রন্থপরিচয় brSR6ł শক্তিটা কোথায় অবস্থিত ? সে কি আমাদের নিজের গায়ের জোরে না ইংরেজশাসনতন্ত্রের ক্ষমাগুণে ! যখনই সেই ক্ষমাগুণের লেশমাত্ৰ বৈলক্ষণ্য দেখি, যখনই মানবধর্মবিশত স্পর্ধার বিরুদ্ধে ক্ষমতাশালীর আক্রোশ আইনের বেড়ার কোনো-একটা অংশ একটুমাত্র আলগা করিয়া ফেলে, অমনি আমরা বিস্মিত ও উৎকণ্ঠিত হইয়া উঠি এবং তৎক্ষণাৎ প্রমাণ করিয়া দিই যে, পরের ধৈর্যের প্রতি বিশ্বাসস্থাপন করিয়াই আমরা পরকে উদবেজিত করিতেছিলাম। আমাদের স্পর্ধা যদি যথার্থ আমাদেরই শক্তি হইতে উদ্ভূত হইত। তবে অপর পক্ষের স্বাভাবিক রোষ এবং শাসনের কাঠিন্য আমরা স্বীকার করিয়া লইতাম, তবে উদ্যতমুষ্ঠি দেখিবামাত্র তৎক্ষণাৎ আমরা মিন্টো-মর্লির দোহাই পাড়িতে ও আদালতের আবদার কাড়িতে ছুটিতাম না। এ কথা মানিতেই হয় যে, স্বভাবের নিয়মে স্পর্ধার বিরুদ্ধে ক্ৰোধ উৎপন্ন হইয়া থাকে এবং সক্ষমের ক্ৰোধ কোনো-না-কোনো উপায়ে হিংসার আকার ধারণ করে । যদি আমরা ইংরেজকে বলি “তােমাকে জব্দ করিবার জন্যই আমরা দেশের ভালো করিতেছি' এবং তার পরে ইংরেজ রক্তচক্ষু হইবামাত্র বলি "বাঃ, আমরা দেশের ভালো করিতেছি- তোমরা রাগ করিতেছি কেন', তবে গাভীর্য রক্ষা করা কঠিন হয় । জব্দ করিতে পারার একটা সুখ আছে সন্দেহ নাই, কিন্তু দেশের ভালো করিতে পারার সুখ যদি তাহার চেয়ে বড়ো হয় তবে তাঁহারই খাতির রাখিতে হয় । আমরা বয়কট করিয়াই দেশী কাপড় চালাইতে প্ৰবৃত্ত হইয়াছি এ কথা বলিবামাত্র দেশী কাপড় চালানো বিষ্মসংকুল হইয়া উঠে, সুতরাং জব্দ করিবার সুখ ভোগ করিতে গিয়া ভালো করিবার সুখ খর্ব করিতে হয় । দেশী কাপড় চালানো ইংরেজের বিরুদ্ধে আমাদের একটা লড়াই, এ কথা বলিলেই যাহা আমাদের চিরন্তন মঙ্গলের পবিত্র ব্যাপার তাহাকে মল্লবেশ পরাইয়া পোলিটিকাল আখড়ায় টানিয়া আনিতে হয় ; ইংরেজ তখন এই উদযোগকে কেবল যে নিজের দেশের তাতির লোকসান বলিয়া দেখে তাহা নয়, এই হারজিতের ব্যাপারকে একটা পােলিটিকাল সংগ্রাম বলিয়া গণ্য করে। ইহাতে ফল হয় এই যে নিজের দুর্বল প্রবৃত্তি চরিতার্থ করিবার উদ্দেশে আমরা স্বদেশের হিতকে ইচ্ছাপূর্বক বিপদের মুখে ফেলিয়া দিই। আমাদের দেশে তো অন্তরে-বাহিরে, নিজের চরিত্রে ও পরের প্রতিকূলতায় বিয়া ভুরি ভুরি আছে ; তাহার পরে আস্ফালন করিয়া নূতন বিদ্মকে হাক দিয়া ডাকিয়া আনিব, এতবড়ো অনাবশ্যক শক্তিক্ষয়ের উপযুক্ত সঞ্চয়-যে আমাদের কোথায় আছে তাহার সন্ধান তো আমি জানি না । বড়ো বড়ো স্বাধীন জাতিকেও বিবেচনা করিয়া চলিতে হয়, স্তব্ধ হইয়া থাকিতে হয়। স্বজাতির মঙ্গল সম্বন্ধে যাহাদের দায়িত্ববোধ আছে তাহারা তেজস্বী হইলেও অনেক লাঙ্গুলমর্দিন বিনস্রফণায় নিঃশব্দে স্বীকার করে- ইংলন্ড ফ্রান্স জর্মনিতে ইহার অনেক দৃষ্টান্ত দেখা গেছে। জাপান চীনের সঙ্গে লড়াইয়ে জয়ী হইয়াও রাশিয়ার চক্রান্তে লড়াইয়ের ফল যখন ভোগ করিতে পারে নাই তখন চুপ করিয়া ছিল— আজ রাশিয়াকে পরাস্ত করিয়া বন্ধুদের মধ্যস্থতায় যখন রক্তপাতের পুরা মূল্য আদায় করিতে পারিল না। তখন হাস্যমুখে বন্ধুগণকে ধন্যবাদ জানাইল । কেন ? ইহার কারণ, অসহিষ্ণু হইয়া তেজ দেখাইতে যাওয়াই দুর্বলতা, দেশের মঙ্গলকে শিরোধাৰ্য করিয়া স্তব্ধ হইয়া থাকাই যথার্থ বীরত্ব । যদি ইংলন্ড ফ্রান্স জাপানের পক্ষে এ কথা সত্য হয়, যদি তাহারা ঔদ্ধত্যপ্রকাশ করিয়া উন্নতির যাত্রাপথে স্বজাতির বোঝা বাড়াইয়া তুলিতে সর্বদাই কুষ্ঠিত হয়, তবে আমাদের এই অতিক্ষুদ্র কর্মক্ষেত্রে কেবল কথায় কথায় সশব্দে তাল ঠুকিয়া বেড়ানােই কি আমাদের পক্ষে সকলের চেয়ে বড়ো কাজ বলিয়া গণ্য করিতে হইবে। যথাসাধ্য মৌন থাকিয়া, স্তন্ধ থাকিয়া, আমাদের চলিবার পথের বিপুলকায় বিত্মদৈত্যগুলিকে নিদ্রিত রাখাই কি আমাদের কর্তব্য হইবে না। অবশ্য, কারণ ঘটিলে ক্ষোভ অনুভব না করিয়া থাকা যায় না- কিন্তু অসময়ে অকিঞ্চিৎকারভাবে সেই ক্ষোভের অপব্যয় করা না-করা আমাদের আয়ত্তাধীন হওয়া উচিত । --বঙ্গদর্শন। জ্যৈষ্ঠ ১৩১৩