পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (প্রথম খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/৪৫৭

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

বউ-ঠাকুরানীর হাট । ७११ আমার আশা, কী মায়ামস্ত্রে সে আঁধার দূর করিলে " যুবরাজ বার বার স্বরমার মুখচুম্বন করিলেন। সুরমা কিছুই কথা কহিল না, আনন্দে তাহার চোখ জলে পুরিয়া আসিল। যুবরাজ কহিলেন, । "এতদিনের পরে আমি যথার্থ আশ্রয় পাইলাম। তোমার কাছে প্রথম শুনিলাম যে আমি নির্বোধ নই, তাহাই বিশ্বাস করিলাম, তাহাই বুঝিতে পারিলাম । তোমারই কাছে শিখিলাম বুদ্ধি অন্ধকারময় ক্ষুদ্র গলির মতো বঁকাচোরা উচুনিচু নহে, রাজপথের ন্যায় সরল সমতল প্রশস্ত। পূর্বে আমি আপনাকে স্বণা করিতাম, আপনাকে অবহেলা করিতাম । কোনে কাজ করিতে সাহস করিতাম না । মন যদি বলিত, ইহাই ঠিক, আত্মসংশয়ী সংস্কার বলিত, উহা ঠিক না হইতেও পারে। যে যেরূপ ব্যবহার করিত তাহাই সহিয়া থাকিতাম, নিজে কিছু ভাবিতে চেষ্টা করিতাম না । এতদিনের পরে আমার মনে হইল, আমি কিছু, আমি কেহ । এতদিন আমি অগোচর ছিলাম, তুমি আমাকে বাহির করিয়াছ, সুরমা তুমি আমাকে আবিষ্কার করিয়াছ, এখন আমার মন যাহা ভালো বলে, তৎক্ষণাৎ তাহা আমি সাধন করিতে চাই। তোমার উপর আমার এমন বিশ্বাস আছে যে, তুমি যখন আমাকে বিশ্বাস কর, তখন আমিও আমাকে নিৰ্ভয়ে বিশ্বাস করিতে পারি। মুকুমার শরীরে এত বল কোথায় ছিল যাহাতে আমাকেও তুমি বলীয়ান করিয়া তুলিয়াছ ?” কী অপরিসীম নির্ভরের ভাবে সুরমা স্বামীর বক্ষ বেষ্টন করিয়া ধরিল। কী সম্পূর্ণ আত্মবিসঙ্গী দৃষ্টিতে র্তাহার মুখের দিকে চাহিয়া রহিল। তাহার চোখ কহিল, “আমার আর কিছুই নাই কেবল তুমি আছ, তাই আমার সব আছে।” বাল্যকাল হইতে উদয়াদিত্য আত্মীয়-স্বজনের উপেক্ষ সহিয়া আলিতেছেন, মাঝে মাঝে এক-একদিন নিস্তব্ধ গভীর রাত্রে সুরমার নিকট সেই শতবার-কথিত পুরানো জীবনকাহিনী খণ্ডে খণ্ডে সোপানে সোপানে আলোচনা করিতে র্তাহার বড়ো ভালো লাগে । উদয়াদিত্য কহিলেন, “এমন করিয়া আর কতদিন চলিবে সুরমা ? এদিকে রাজসভায় সভাসদগণ কেমন একপ্রকার কৃপাদৃষ্টিতে আমার প্রতি চায়, ওদিকে অস্তঃপুরে মা তোমাকে লাঞ্ছনা করিতেছেন। দাসদাসীরা পর্যন্ত তোমাকে তেমন মানে না। আমি কাহাকে ও ভালো করিয়া কিছু বলিতে পারি না, চুপ করিয়া থাকি, সহ করিয়া যাই। তোমার তেজস্ব স্বভাব, কিন্তু তুমিও নীরবে সহিয়া যাও । যখন তোমাকে সুখী করিতে পারিলাম না, আমি হইতে তোমাকে কেবল অপমান আর কষ্ট সহ করিতে হইল, তখন আমাদের এ বিবাহ ন হইলেই ভালো ছিল ।” , ।