পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (প্রথম খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/৪৯২

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

8>ર” রবীন্দ্র-রচনাবলী থাকিলেও অবসর পাইলে সে এক-একবার বিভাকে দেখিতে আলিত । রামমোহনকে বিভী কিছুমাত্র লজ্জা করিত না । বৃদ্ধ বলিষ্ঠ দীর্ঘ রামমোহন যখন “মা” বলিয়া আসিয়া দঁড়াইত তখন তাহার মধ্যে এমন একটা বিশুদ্ধ সরল অলংকারশূন্ত মেছেঞ্জ ভাব থাকিত যে, বিভা তাহার কাছে আপনাকে নিতান্ত বালিকা মনে করিত। । বিভা তাহাকে কহিল, “মোহন, তুই এতদিন আসিস নাই কেন ?” রামমোহন কহিল, “তা মা, কুপুত্র যদি বা হয়, কুমাতা কখনো নয়’, তুমি কোন আমাকে মনে করিলে ? আমি মনে মনে কছিলাম, 'মা না ডাকিলে আমি যাব না, দেখি, কতদিনে তার মনে পড়ে। তা কই, একবারও তো মনে পড়িল না ।” *F বিভ। ভারি মুশকিলে পড়িল। সে কেন ডাকে নাই, তাহা ভালো করিয়া বলিতে পারিল না। তাহা ছাড়া, ডাকে নাই বলিয়া যে মনে করে নাই, এই কথাটার মধ্যে এক জায়গায় কোথায় যুক্তির দোষ আছে বলিয়া মনে হইতেছে, অথচ ভালো করিয়া বুঝাইয়া বলিতে পারিতেছে না । বিভার মুশকিল দেখিয়া রামমোহন হাসিয়া কহিল, “না মা, অবসর পাই নাই বলিয়া আসিতে পারি নাই।” বিভা কহিল, “মোহন, তুই ব’স ; তোদের দেশের গল্প আমায় বলু।” রামমোহন বলিল। চন্দ্রদ্বীপের বর্ণনা করিতে লাগিল ৷ বিভা গলে হাত দিয়া একমনে শুনিতে লাগিল। চন্দ্রদ্বীপের বর্ণনা শুনিতে শুনিতে তাহার হৃদয়টুকুর মধ্যে কত কী কল্পনা জাগিয়া উঠিয়াছিল, সেদিন সে আসমানের উপর কত ঘরবাড়িই বাধিয়াছিল তাছার আর ঠিকানা নাই। যখন রামমোহন গল্প করিল গত বর্ষার বন্যায় তাহার ঘরবাড়ি সমস্ত ভাসিয়া গিয়াছিল, সন্ধ্যার প্রাক্কালে সে একাকী তাহার বৃদ্ধ মাতাকে পিঠে করিয়া সাতার দিয়া মন্দিরের চুড়ায় উঠিয়াছিল ও দুই জনে মিলিয়া সমস্ত রাত্রি সেখানে যাপন করিয়াছিল তখন বিভার ক্ষুদ্ৰ বুকটির মধ্যে কী হৃং কম্পই উপস্থিত হইয়াছিল। গল্প ফুরাইলে পর রামমোহন কহিল, “মা, তোমার জন্য চারগাছি শাখা আনিয়াছি, তোমাকে ঐ হাতে পরিতে হইবে, আমি দেখিব।” বিভা তাহার চারগাছি সোনার চুড়ি খুলিয়া শাখা পরিল ও হালিতে হাসিতে মায়ের কাছে গিয়া কহিল, “মা, মোহন তোমার চুড়ি খুলিয়া আমাকে চারগাছি শাখা পরাইয়া দিয়াছে।” মহিষী কিছুমাত্র অসন্তুষ্ট না হইয়া হাসিয়া কছিলেন, “তা বেশ তো সাজিয়াছে, বেশ তো মানাইয়াছে।”