পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (প্রথম খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/৪৯৩

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

বউ-ঠাকুরানীর হাট । ৪১৩ রামমোহন অত্যন্ত উৎসাহিত ও গর্বিত হই উঠিল। মহিষী তাঁহাকে ডাকাইয় লইয়া গেলেন, নিজে উপস্থিত থাকিয় তাহাকে আহার করাইলেন । সে তৃপ্তিপূর্বক ভোজন করিলে পর তিনি অত্যন্ত সন্তুষ্ট হইয়া কছিলেন, “মোহন, এইবারে তোর সেই আগমনীর গানটি গা ।” রামমোহন বিতার দিকে চাহিয়া গাহিল, “সারা বরষ দেখি নে মী, মা তুই আমার কেমনধারা, নয়নতারা হারিয়ে আমার অন্ধ হল নয়নতারা । এলি কি পাষাণী ওরে দেখব তোরে আঁখি ভরে কিছুতেই থামে না যে মা, পোড়া এ নয়নের ধারা ।” রামমোহনের চোখে জল আসিল, মহিষীও বিভার মুখের দিকে চাহিয়া চোখের জল মুছিলেন। আগমনীর গানে তাহার বিজয়ার কথা মনে পড়িল । ক্রমে সন্ধ্যা হইয়া আসিল । পুরমহিলাদের জনতা বাড়িতে লাগিল । প্রতিবেশিনীর জামাই দেখিবার জন্ত ও সম্পর্ক অনুসারে জামাইকে উপহাস করিবার জন্য অস্তঃপুরে সমাগত হইল। আনন্দ, লজ্জা আশঙ্কা, একটা অনিশ্চিত অনির্দেগু না-জানি-কী-হুইবে ভাবে বিভার হৃদয় তোলপাড় করিতেছে, তাহার মুখ-কান লাল হইয়া উঠিয়াছে, তাহার হাত-পা শীতল হইয়া গিয়াছে। ইহা কষ্ট কি মুখ কে জানে! জামাই অন্তঃপুরে আসিয়াছেন। হলবিশিষ্ট সৌন্দর্যের বীকের ন্যায় রমণীগণ চারিদিক হইতে র্তাহাকে আক্রমণ করিয়াছে। চারিদিকে হাসির কোলাহল উঠিল । চারিদিক হইতে কোকিল-কণ্ঠের তীব্ৰ উপহাস, মৃণাল-বাহুর কঠোর তাড়ন, চম্পকঅঙ্গুলির চন্দ্র-নখরের তীক্ষ পীড়ন চলিতে লাগিল। রামচন্দ্র রায় যখন নিতান্ত কাতর হইয়া পড়িয়াছেন, তখন একজন প্রৌঢ়া রমণী আসিয়া তাহার পক্ষ অবলম্বন করিয়া বসিল । সে কঠোর কণ্ঠে এমনি কাটা কাটা কথা কহিতে লাগিল ও ੇ তাহার মুখ দিয়া এমনি সকল রুচির বিকার বাহির হইতে লাগিল যে পুররমণীদের মুখ একপ্রকার বন্ধ হইয়া আসিল । তাহার মুখের কাছে থাকোদিদিও চুপ করিয়া গেলেন । বিমলাদিদি ঘর হইতে উঠিয়া চলিয়া গেলেন। কেবল ভূতোর মা তাহাকক খুব এক কথা শুনাইয়াছিল। যখন উল্লিখিত ভূতোর মার মুখ খুব চলিতেছিল, তখন সেই প্রৌঢ় তাহাকে বলিয়াছিল, "মাগো মা, তোমার মুখ নয় তো, একগাছা বাট ।” ভূতোর মা তৎক্ষণাৎ কহিল, “আর মাগি, তোর মুখটা আঁস্তাকুড়, এত ঝাটাইলাম তবুও সাফ হইল না।” বলিয়া গল গল করিয়া চলিয়া গেল। একে একে ঘর খালি হইল, রামচন্দ্র রায় বিরাম পাইলেন।