পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (প্রথম খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/৫৩৭

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

8૯૧ তৃণজ্ঞান করিয়া অত্যাচারের বিরুদ্ধে প্রাণপণ করিতে এখন আর পারেন না। সকল কাজেই ইতস্তত করেন, সকল বিষয়েই সংশয় উপস্থিত হয়। একদিন উদয়াদিত্য শুনিলেন, ছাপরার জমিদারের কাছারিতে রাত্ৰিযোগে লাঠিয়াল পাঠাইয়া কাছারি লুট করিবার ও কাছারিতে আগুন লাগাইয়া দিবার আদেশ হইয়াছে। উদরাদিত্য তৎক্ষণাৎ তাহার অশ্ব প্রস্তুত করিতে কহিয়া । অন্তঃপুরে গেলেন। শয়নগৃহে প্রবেশ করিয়া একবার চারিদিক দেখিলেন। কী ভাবিতে লাগিলেন। ভাবিতে ভাবিতে অন্তমনস্ক হইয়া বেশ পরিবর্তন করিতে লাগিলেন। বাহিরে আসিলেন। ভূত্য আসিয়া কহিল, “যুবরাজ, অশ্ব প্রস্তুত হইয়াছে। কোথায় যাইতে হইবে ?” যুবরাজ কিছুক্ষণ অন্তমনস্ক হইয়া ভূত্যের মুখের দিকে চাহিয়া রছিলেন ও অবশেষে কছিলেন, “কোথাও না। তুমি অশ্ব লইয়া যাও।” 彎 একদিন এক ক্রনীনের শব্দ শুনিতে পাইয়া উদয়াদিত্য বাহির হইয়া আসিলেন, দেখিলেন, রাজকর্মচারী এক প্রজাকে গাছে বধিয়া মারিতেছে। প্রজা কাদিয়া যুবরাজের মুখের দিকে চাহিয়া কহিল, “দোহাই যুবরাজ” । যুবরাজ তাহার যন্ত্রণা দেখিতে পারিলেন না, তাড়াতাড়ি ছুটিয়া গৃহের মধ্যে প্রবেশ করিলেন । আগে হইলে ফলাফল বিচার না করিয়া কৰ্মচারীকে বাধা দিতেন, প্রজাকে রক্ষণ করিতে চেষ্টা করিতেন। ভাগবত ও সীতারামের বৃত্তি বন্ধ হইয়া গেছে । তাহাদিগকে প্রকাশ্বে অথবা গোপনে অর্থ সাহায্য করিতে যুবরাজের আর সাহস হয় না। যখনই তাহদের কষ্টের কথা শুনেন, তখনই মনে করেন, “আজই আমি টাকা পাঠাইয়া দিব।” তাহার পরেই ইতস্তত করিতে থাকেন, পাঠানে আর হয় না। কেহ যেন না মনে করেন, উদয়াদিত্য প্রাণের ভয়ে এরূপ করিতেছেন । সম্প্রতি জীবনের প্রতি তাহার যে পূর্বাপেক্ষা বিশেষ আসক্তি জন্মিয়াছে তাহা নহে। তাহার মনে একটা অন্ধ ভয় উপস্থিত হইয়াছে। প্রতাপাদিত্যকে তিনি যেন রহস্যময় কী একটা মনে করেন। যেন উদয়াদিত্যের অদৃষ্ট, উদয়াদিত্যের ভবিষ্যৎ জীবনের প্রতিদিন প্রতি মুহূর্ত প্রতাপাদিত্যের মুষ্টির মধ্যে রহিয়াছে। উদয়াদিত্য যখন মৃত্যুকে আলিঙ্গন করিতে যাইতেছেন, জীবনের শেষ মুহূর্তে অবস্থান করিতেছেন, তখনও যদি প্রতাপাদিত্য ভ্ৰকুঞ্চিত করিয়া বাচিতে আদেশ করেন, তাহা হইলে যেন তখনও তাহাকে মৃত্যুর মুখ হইতে ফিরিয়া আসিতে হইবে।