পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (প্রথম খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/৬০৭

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

য়ুরোপ-প্রবাসীর পত্র ৫২৭ তার পরে লেখার জঙ্গলগুলো সাফ করবামাত্র দেখা গেল, এর মধ্যে শ্রদ্ধা বস্তুটাই ছিল গোপনে, অশ্রদ্ধাটা উঠেছিল বাহিরে আগাছার মতো নিবিড় হয়ে । আসল জিনিসটাকে তারা আচ্ছন্ন করেছিল, কিন্তু নষ্ট করে নি । এইটে আবিষ্কার করে আমার মন অত্যন্ত প্রসন্ন হয়েছে । কেন না, নিন্দানৈপুণ্যের প্রাখৰ্ষ ও চাতুর্যকে আমি সর্বাস্তঃকরণে ঘৃণা করি। ভালো লাগবার শক্তিই বিধাতার শ্রেষ্ঠ পুরস্কার মানবজীবনে । সাহিত্যে কুৎসাবিলাসীদের ভোজের দাদন আমি নিই নি, আর কিছু না হোক, এই পরিচয়টুকু আমি রেখে যেতে চাই । একটা কথা আপনাকে বলা বাহুল্য । ইংরেজের চেহারা সেদিন আমার চোখে যেমনটা ধরা পড়েছিল সেটা যে নেহাত আমার বাল্যবুদ্ধি ও অনভিজ্ঞতার স্বষ্টি সে-কথা বললে সম্পূর্ণ সত্য কথা বলা হবে না । এই প্রায় ষাট বছরের মধ্যে সেখানকার মানুষের যে পরিবর্তন হয়েছে তাকে ক্রমশ অভিব্যক্তির আখ্যা দেওয়া যায় না । এক-এক সময়ে ইতিহাস-শতরঞ্চের বোড়ে তার এক পা চাল ছেড়ে দিয়ে লম্বা চালে চলতে শুরু করে । পাশ্চাত্যে তাই ঘটেছে। সেদিনকার পাসপোর্টে তার যে ছবিটা ছিল সে ছবি আজ একেবারেই চলবে না । সেই প্রথম-বয়সে যখন ইংলণ্ডে গিয়েছিলুম ঠিক মুসাফেরের মতো যাই নি। অর্থাৎ রাস্তা থেকে চলতে চলতে বাহির থেকে চোখ বুলিয়ে যাওয়া বরাদ্দ ছিল না। ছিলেম অতিথির মতো, ঘরের মধ্যে প্রবেশ পেয়েছিলুম। সেবা পেয়েছি, স্নেহ পেয়েছি, কোথাও কোথাও ঠকেছি, দুঃখ পেয়েছি। কিন্তু তার পরে আবার যখন সেখানে গিয়েছি, তখন সভায় থেকেছি, ঘরে নয়। আমার তৎপূর্বকালে অভিজ্ঞতা সর্বাঙ্গসম্পূর্ণ যদি না হয় তবু সত্য। যে ডাক্তারের বাড়িতে ছিলুম তিনি ভদ্রশ্রেণীর এবং শ্রদ্ধেয়, কিন্তু সমুদয় ভদ্রশ্রেণীর প্রতীক তিনি না হতে পারেন। ইংলগুে আজও বর্ণসাম্য যতই থাকু শ্রেণীভেদ যথেষ্ট । সেখানে এক শ্রেণীর সঙ্গে আর-এক শ্রেণীর মনোবৃত্তি ও ব্যবহারের মিল না থাকাই স্বাভাবিক । সেদিনও নিঃসন্দেহ ছিল না। আমি সেদিনকার সাধারণ গৃহস্থ-ঘরের এবং একটি বিলাসিনী-ঘরের পরিচয় কাছে থেকেই পেয়েছি । তার কিছু কিছু বর্ণনা চিঠিগুলির মধ্যে আছে।