পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (প্রথম খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/৬১৫

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

যুরোপ-প্রবাসীর পত্র Q○ ● উপরে যেন অবসন্ন হয়ে পড়েছে। আয়নার মতো পরিষ্কার শাস্ত সমুদ্রের উপর ছোটো ছোটো পাল তোলা নৌকাগুলি আবার কেমন ছবির মতো দেখাচ্ছে । এডেনে পৌছে বাড়ীতে চিঠি লিখতে আরম্ভ করলেম কিন্তু লিখতে গিয়ে দেখি ষে এই ক-দিন নাড়াচাড়া খেয়ে মাথার ভিতরে যেন সব উলটোপালটা হয়ে গেছে, বুদ্ধির রাজ্যে একট। অরাজকতা ঘটেছে। কী করে লিখব, ভালো মনে আসছে না। ভাবগুলো যেন মাকড়সার জালের মতো, ছুতে গেলেই অমনি ছিড়েখুড়ে যাচ্ছে । কিসের পর কী লিখব, তার একটা ভালোরকম বন্দোবস্ত করতে পারছি নে । এই অবস্থায় লিখতে আরম্ভ করলেম, এমন বিপদে পড়ে তোমাকে যে লিখতে পারি নি তাতে তোমার ক্ষোভের কারণ কিছুই নেই। | দেখো, সমুদ্রের উপর আমার কতকটা অশ্রদ্ধা হয়েছে । কল্পনায় সমুদ্রকে যা মনে করতেম, সমুদ্রে এসে দেখি তার সঙ্গে অনেক বিষয় মেলে না । তীর থেকে সমুদ্রকে খুব মহান বলে মনে হয়, কিন্তু সমুদ্রের মধ্যে এলে আর ততটা হয় না। তার কারণ আছে ; আমি যখন বম্বের উপকূলে দাড়িয়ে সমুদ্র দেখতেম, তখন দেখতেম দূরদিগন্তে গিয়ে নীল জল নীল আকাশে মিশিয়ে গিয়েছে, কল্পনায় মনে করতেম যে, এক বার যদি ওই দিগন্তের আবরণ ভেদ করতে পারি, ওই দিগন্তের যবনিকা ওঠাতে পারি, অমনি আমার স্বমুখে এক অকুল অনস্ত সমুদ্র একেবারে উথলে উঠবে। ওই দিগস্তের পরে যে কী আছে তা আমার কল্পনাতেই থাকত , তখন মনে হত না, ওই দিগন্তের পরে আর-এক দিগন্ত আসবে। কিন্তু যখন সমুদ্রের মধ্যে এসে পড়ি, তখন মনে হয় যে, জাহাজ যেন চলছে না, কেবল একটি দিগন্তের গণ্ডির মধ্যে বাধা আছে । অামাদের কল্পনার পক্ষে সে দিগন্তের সীমা এত সংকীর্ণ যে কেমন তৃপ্তি হয় না। কিন্তু দেখো, এ-কথা বড়ো গোপনে রাখা উচিত ; বাল্মীকি থেকে বায়রন পর্যস্ত সকলেরই যদি এই সমুদ্র দেখে ভাব লেগে থাকে, তবে আমার না লাগলে দশজনে যে হেসে উঠবে ; গ্যালিলিওর সময়ে এ-কথা বললে হয়তো আমাকে কয়েদ যেতে হত। এত কবি সমুদ্রের স্তুতিবাদ করেছেন যে আজ আমার এই নিন্দায় তার বোধ হয় বড়ো একটা গায়ে লাগবে না। যখন তরঙ্গ ওঠে, তখন বোধ করি সমুদ্র বেশ দেখায়, কিন্তু আমার দুর্ভাগ্যক্রমে সমুদ্রের তরঙ্গ উঠলেই আমার এমন মাথা ঘুরতে থাকে যে আমার দেখাশুনো সব ঘুরে যায়। আমি যখন ঘর থেকে বেরোতে আরম্ভ করলেম, তখন জাহাজের যাত্রীদের উপর আমার নজর পড়ল ও আমার উপর জাহাজের যাত্রীদের নজর পড়ল। আমি স্বভাবতই ‘লেডি’ জাতিকে বড়ো ডরাই । তাদের কাছে ঘেঁষতে গেলে এত প্রকার