পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (প্রথম খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/৬২৫

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

যুরোপ-প্রবাসীর পত্র 48S বললে, আমার শরীর বেশ লম্ব আছে, এখন পাশের দিকে বাড়লে আমি একজন স্বপুরুষের মধ্যে গণ্য হব ; অর্ধ ঘণ্টা ধরে সে আমার সর্বাঙ্গ অবিশ্রান্ত দলন করলে, ভূমিষ্ঠকাল থেকে যত ধুলো মেখেছি, শরীর থেকে সব যেন উঠে গেল। যথেষ্টরূপে দলিত করে আমাকে আর-একটি ঘরে নিয়ে গেল, সেখানে গরম জল দিয়ে, সাবান দিয়ে, স্পঞ্জ দিয়ে শরীরটা বিলক্ষণ করে পরিষ্কার করলে । পরিষ্করণ-পর্ব শেষ হলে আরএকটা ঘরে নিয়ে গেল । সেখানে একটা বড়ো পিচকিরি করে গায়ে গরম জল ঢালতে লাগল, হঠাৎ গরম জল দেওয়া বন্ধ করে বরফের মতো ঠাণ্ডা জল বর্ষণ করতে লাগল ; এইরকম কখনো গরম কখনো ঠাও। জলে স্নান করে একটা জলযন্ত্রের মধ্যে গেলেম, তার উপর থেকে নিচে থেকে চার পাশ থেকে বাণের মতে জল গায়ে বিধতে থাকে । সেই বরফের মতো ঠাণ্ড বরুণ-বাণ-বর্ষণের মধ্যে খানিকক্ষণ থেকে আমার বুকের রক্ত পর্যন্ত যেন জমাট হয়ে গেল— রণে ভঙ্গ দিতে হল, হাপাতে হাপাতে বেরিয়ে এলেম । তার পরে এক জায়গায় পুকুরের মতো আছে, আমি সাতার দিতে রাজি আছি কি না জিজ্ঞাসা করলে । আমি সাতার দিলেম না, আমার সঙ্গী সাতার দিলেন । র্তার সাতার দেওয়া দেখে তারা বলাবলি করতে লাগল “দেখো, দেখো, এরা কী অদ্ভুত রকম করে সাতার দেয়, ঠিক কুকুরের মতো ।” এতক্ষণে স্নান শেষ হল । আমি দেখলেম টার্কিশ-বাথে স্নান করা আর শরীরটাকে ধোপার বাড়ি দেওয়া এক কথা । তার পরে সমস্ত দিনের জন্যে এক পাউণ্ড দিয়ে এক গাড়ি ভাড়া করা গেল। প্যারিস একৃসিবিশন দেখতে গেলেম । তুমি এইবার হয়তো খুব আগ্রহের সঙ্গে কান খাড়া করেছ, ভাবছ আমি প্যারিস একৃসিবিশনের বিষয় কী না জানি বর্ণনা করব । কিন্তু দুঃখের বিষয় কী বলব, কলকাতার য়ুনিভার্সিটিতে বিদ্যা শেখার মতো প্যারিস একৃসিবিশনের সমস্ত দেখেছি কিন্তু কিছুই ভালো করে দেখি নি। একদিনের বেশি আমাদের প্যারিসে থাকা হল না— সে বৃহৎ কাণ্ড একদিনে দেখা কারও সাধ্য নয় । সমস্ত দিন আমরা দেখলেম— কিন্তু সে-রকম দেখায়, দেখবার একটা তৃষ্ণ জন্মাল কিন্তু দেখা হল না । সে একটা নগরবিশেষ । এক মাস থাকলে তবে তা বর্ণনা করবার চুরাশা করতেম। প্যারিস একৃসিবিশনের একটা স্ত,পাকার ভাব মনে আছে, কিন্তু শৃঙ্খলাবদ্ধ ভাব কিছুই মনে নেই। সাধারণত মনে আছে যে চিত্রশালায় গিয়ে অসংখ্য অসংখ্য চমৎকার ছবি দেখেছি, স্থাপত্যশালায় গিয়ে অসংখ্য অসংখ্য প্রস্তরমূর্তি দেখেছি, নানা দেশবিদেশের নানা জিনিস দেখেছি ; কিন্তু বিশেষ কিছু মনে নেই। তার পর প্যারিস থেকে লণ্ডনে এলেম— এমন বিষঃ অন্ধকারপুরী আর কখনো দেখি নি—ধোয়া, মেঘ, বৃষ্টি, কুয়াশা, কাদা আর লোকজনের