পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (প্রথম খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/৬৩৯

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

ছিল। অথচ সেদিন স্বর্য পশ্চিম দিকে ওঠে নি, পর্বত চলাফের করে বেড়ায়নি, বহ্নিও শীতলতা প্রাপ্ত হয় নি । কাপে ট-মোড়া ঘরে তারা সুখে বাস করছেন । তারা বলেন, “আমাদের দেশে নিজের ঘর বলে একটা স্বতন্ত্র পদার্থ ছিল না ; যে-ঘরে বসতেম, সে-ঘরে বাড়ির দশজনে যাতায়াত করছেই । আমি একপাশে লিখছি, দাদা একপাশে একখানা বই হাতে করে ঢুলছেন, আর-এক দিকে মাছুর পেতে গুরুমশায় ভুলুকে উচ্চৈঃস্বরে স্থর করে করে নামত পড়াচ্ছেন। এখানে আমার নিজের ঘর ; সুবিধামতো করে বইগুলি এক দিকে সাজালেম, লেখবার সরঞ্জাম একদিকে গুছিয়ে রাখলেম, কোনো ভয় নেই যে, একদিন পাচটা ছেলে মিলে সমস্ত ওলট-পালট করে দেবে, আর-এক দিন দুটোর সময় কলেজ থেকে এসে দেখব, তিনটে বই পাওয়া যাচ্ছে না, অবশেষে অনেক খোজ-খোজ করে দেখা যাবে বইগুলি নিয়ে আমার ছোট ভাগ্নীটি তার ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র সহচরীদের ডেকে ছবি দেখতে ঘোরতর ব্যস্ত। এখানে নিজের ঘরে বসে থাকো, দরজাটি ভেজানো, সট করে না বলে কয়ে কেউ ঘরের মধ্যে এসে পড়ে না, ঘরে ঢোকবার আগে দরজায় শব্দ করে, ছেলেপিলেগুলো চারিদিকে চেঁচামেচি কান্নাকাটি জুড়ে দেয় নি, নিরিবিলি নিরালা, কোনো হাঙ্গামা নেই।” দেশের সম্বন্ধে মেজাজ খিটখিটে হয়ে ওঠে। প্রায় দেখা যায় আমাদের দেশের পুরুষেরা এখানকার পুরুষ-সমাজে বড় মেশেন না । কারণ এখানকার পুরুষসমাজে মিশতে গেলে একরকম বলিষ্ঠ ফুৰ্ত্তির ভাব থাকা চাই, বাধো-বাধো মিঠে স্বরে দু-চারটে সসংকোচ ‘ই না” দিয়ে গেলে চলে না । বাঙালি অভ্যাগত ডিনার টেবিলে তার পাশ্বস্থ মহিলাটির কানে কানে মিষ্টি মিষ্টি টুকরো টুকরো দুই-একটি কথা মৃদু ধীর স্বরে কইতে পারেন, আর সে মহিলার সহবাসে তিনি যে স্বৰ্গ-মুখ উপভোগ করছেন, তা তার মাথার চুল থেকে বুট জুতোর আগ পর্যন্ত প্রকাশ হতে থাকে, স্বতরাং মেয়ে-সমাজে বাঙালিরা পসার করে নিতে পারেন। আমাদের দেশে ঘোমটাচ্ছন্নমুখচন্দ্রশ্লোভী অনালোকিত অন্তঃপুর থেকে এখানকার রূপের মুক্ত জ্যোৎস্নায় এসে আমাদের মন-চকোর প্রাণ খুলে গান গেয়ে ওঠে । এক দিন আমাদের নবাগত বঙ্গযুবক তার প্রথম ডিনারের নিমন্ত্রণে গিয়েছেন । নিমন্ত্রণসভায় বিদেশীর অত্যন্ত সমাদর। তিনি গৃহস্বামীর যুবতী কন্যা মিস অমুকের বাহু গ্রহণ করে আহারের টেবিলে গিয়ে বললেন । আমাদের দেশের স্ত্রীলোকদের সঙ্গে মুক্তভাবে মিশতে পাই নে, তার পরে নতুন নতুন এসে এখানকার স্ত্রীলোকদের ভাৰও ঠিক বুঝতে পারি নে। কোনো সামাজিকতার অনুরোধে তারা আমাদের