পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (প্রথম খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/৬৫৫

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

য়ুরোপ-প্রবাসীর পত্র ৫৭১ হয়, সে-ঘর পরিষ্কার আছে কি না, জিনিসপত্র যথাপরিমিত আনা হয়েছে কি না, যথাস্থানে রাখা হয়েছে কি না ইত্যাদি দেখাশুনে করা ; রান্না ও খাবার জিনিস আনতে হুকুম দেওয়া, পয়সা রাচাবার জন্যে নানাপ্রকার গিন্নিপনার চাতুরী খেলা, কালকের মাংসের হাড়গোড় কিছু যদি অবশিষ্ট থাকে তা হলে বন্দোবস্ত করে তার থেকে আজকের সুপ চালিয়ে নেওয়া, পরশু দিনকার বাসি রাধা মাংস যদি খাওয়াদাওয়ার পর খানিকটা বাকি থাকে তা হ’লে সেটাকে রূপান্তরিত করে আজকের টেবিলে আনবার স্থবিধে করে দেওয়া, এইরকম নানাপ্রকার গৃহিণীপনা । তার পর ছেলেদের জন্য মোজা কাপড়-চোপড়, এমন কি নিজেরও অনেক কাপড় নিজে তৈরি করেন । এদের সকলের ভাগ্যে নভেল পড়া ঘটে ওঠে না ; বড়োজোর খবরের কাগজ পড়েন, তাও সকলে পড়েন না দেখেছি ; অনেকের পড়াশুনোর মধ্যে কেবল চিঠি পড়া ও চিঠি লেখা, দোকানদারদের বিল পড়া ও হিসাব লেখা । তারা বলেন, “পলিটিক্স এবং অন্যান্য গ্রাম্ভারি বিষয় নিয়ে পুরুষেরা নাড়াচাড়া করুন ; আমাদের কর্তব্য কাজ স্বতন্ত্র।” দুর্বলতা মেয়েদের একটা গর্বের বিষয় ; সুতরাং অনেক মেয়ে শ্রাস্ত না হলেও এলিয়ে পড়েন। বুদ্ধিবিদ্যার বিষয়েও এইরকম ; মেয়েরা জাক করে বলেন, “আমরা বাপু ও-সব বুঝিমুঝি নে।” বিদ্যার অভাব, বুদ্ধির খর্বতা একটা প্রকাশু জাকের বিষয় হয়ে ওঠে । এখানকার মধ্যবিত্ত শ্রেণীর মেয়েরা বিদ্যাচর্চার দিকে ততটা মনোযোগ দেন না, তাদের স্বামীরাও তার জন্যে বড়ো দুঃখিত নন, র্তাদের জীবন হচ্ছে কতকগুলি ছোটোখাটো কাজের সমষ্টি । সন্ধ্যেবেলায় স্বামী কর্মক্ষেত্র থেকে এলে একটি আদরের চুম্বন উপার্জন করেন ; ( পরিবার-বিশেষে যে তার অন্যথা হয় তা বলাই বাহুল্য ) ঘরে র্তার জন্যে আগুন জালানো, খাবার সাজানো আছে । সন্ধ্যেবেলায় স্ত্রী হয়তো একটা সেলাই নিয়ে বসলেন, স্বামী তাকে একটি নভেল চেচিয়ে পড়ে শোনাতে লাগলেন, সুমুখে আগুন জলছে, ঘরটি বেশ গরম, বাইরে পড়ছে বৃষ্টি, জানলা-দরজাগুলি বন্ধ । হয়তো স্ত্রী পিয়ানো বাজিয়ে স্বামীকে খানিকটা গান শোনালেন। এখানকার মধ্যবিত্ত শ্রেণীর গিন্নিরা সাদাসিদে। যদিও র্তারা ভালো করে লেখাপড়া শেখেন নি, তবু তারা অনেক বিষয় জানেন, এবং তাদের বুদ্ধি যথেষ্ট পরিষ্কার। এদেশে কথায় বার্তায় জ্ঞানলাভ করা যায়, তারা অন্তঃপুরে বন্ধ নন, বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে আলাপ করেন, আত্মীয়-সভায় একটা কোনো উচ্চ বিষয় নিয়ে চর্চা হলে তারা শোনেন ও নিজের বক্তব্য বলতে পারেন, বুদ্ধিমান ব্যক্তিরা একটা বিষয়ের কত দিক দেখেন ও কী রকম চক্ষে দেখেন তা বুঝতে পারেন। সুতরাং একটা কথা উঠলে কতকগুলো ছেলেমাস্তুষি আকাশ-থেকে-পড়া প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করেন না