রবীন্দ্র-রচনাবলী و بنابراه সমাপ্তি এবং বিদ্যুৎবান যখন প্রচলিত হবে তখন বিরহ এত গাঢ় হবে যে, চতুর্দশপদীও তার পক্ষে ঢ়িলে বোধ হবে । স্বর্য অস্তপ্রায়। জাহাজের ছাদের উপর হালের কাছে দাড়িয়ে ভারতবর্ষের তীরের দিকে চেয়ে রইলুম। সমূত্রের জল সবুজ, উীরের রেখা নীলাভ, আকাশ মেঘাচ্ছন্ন। সন্ধ্য রাত্রির দিকে এবং জাহাজ সমুদ্রের মধ্যে ক্রমশই অগ্রসর হচ্ছে । বামে বোম্বাই বন্দরের দীর্ঘ রেখা এখনও দেখা যাচ্ছে । ক্রমে বন্দর ছাড়িয়ে গেলুম। সন্ধ্যার মেঘাবৃত অন্ধকারটি সমুদ্রের অনস্ত শয্যায় দেহ বিস্তার করলে। আকাশে তারা নেই। কেবল দূরে লাইট-হাউসের আলো জলে উঠল ; সমুদ্রের শিয়রের কাছে সেই কম্পিত দীপশিখা যেন ভাসমান সন্তানদের জন্যে ভূমিমাতার আশঙ্কাকুল জাগ্রত দৃষ্টি । জাহাজ বোম্বাই বন্দর পার হয়ে গেল । ভাসল তরী সন্ধ্যেবেলা, ভাবিলাম এ জলখেলা, মধুর বহিবে বায়ু ভেসে যাব রঙ্গে । কিন্তু সী-সিক্নেসের কথা কে মনে করেছিল ! যখন সবুজ জল ক্রমে নীল হয়ে এল এবং তরঙ্গে তরীতে মিলে আন্দোলন উপস্থিত করে দিলে তখন দেখলুম সমুদ্রের পক্ষে জলখেলা বটে কিন্তু আমার পক্ষে নয় । ভাবলুম এই বেলা মানে মানে কুঠরির মধ্যে ঢুকে কম্বলটা মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়ি গে। যথাসত্বর ক্যাবিনের মধ্যে প্রবেশ করে র্কাধ থেকে কম্বলটা বিছানার উপর ফেলে দরজা বন্ধ করে দিলুম। ঘর অন্ধকার । বুঝলুম, আলো নিবিয়ে দিয়ে দাদা তার বিছানায় শুয়েছেন। শারীরিক দুঃখ নিবেদন করে একটুখানি স্নেহ উদ্রেক করবার অভিপ্রায়ে জিজ্ঞাসা করলুম, “দাদা, ঘুমিয়েছেন কি ?” হঠাৎ নিতান্ত বিজাতীয় মোটা গলায় কে একজন হুংকার দিয়ে উঠল, “হুজ দ্যাট “ আমি বললুম, “বাস রে! এ তো দাদা নয় ।” তৎক্ষণাৎ বিনীত অমৃতপ্ত স্বরে স্থাপন করলুম, “ক্ষমা করবেন, দৈবক্রমে ভুল কুঠরিতে প্রবেশ করেছি।” অপরিচিত কণ্ঠ বললে, “অল রাইট ” কম্বলটি পুনশ্চ তুলে নিয়ে কাতর শরীরে সংকুচিত চিত্তে বেরোতে গিয়ে দেখি দরজা খুজে পাই নে। বাক্স তোরঙ্গ লাঠি বিছানা প্রভৃতি বিচিত্র জিনিসের মধ্যে খটু খটু শব্দে হাতড়ে বেড়াতে লাগলুম। ইদুর কলে পড়লে তার মানসিক ভাব কী রকম হয় এই অবসরে কতকটা বুঝতে পারা যেত, কিন্তু তার সঙ্গে সমুদ্রপীড়ার সংযোগ হওয়াতে ব্যাপারটা অপেক্ষাকৃত জটিল হয়ে পড়েছিল ।