পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (প্রথম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/১০

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

ভূমিকা বিশ্বভারতী গ্ৰন্থপ্রকাশ-সমিতির অধ্যাক্ষেরা আমার গদ্য পদ্য সমস্ত লেখা একসঙ্গে জড়ো করে বিশেষভাবে সাজিয়ে ছাপাবার সংকল্প করেছেন । কাজটি পরিমাণে বৃহৎ এবং সম্পাদনায় দুঃখসাধ ; এরকম অনুষ্ঠান আমাদের দেশের সকল শ্রেণীর সাহিত্যাবিচারকদের সম্পূর্ণ মনের মতো করে তোলা কারও শক্তিতে নেই। এ কথা নিশ্চিত জেনে নিজে এর দায়িত্ব থেকে নিষ্কৃতি নিয়েছি। যারা সাহস করে এর ভার বহন করতে প্ৰস্তুত তাদের জন্যে উদবিগ্ন রইলুম। অতি অল্প বয়স থেকে স্বভাবতই আমার লেখার ধারা আমার জীবনের ধারার সঙ্গে সঙ্গেই অবিচ্ছিন্ন এগিয়ে চলেছে। চারিদিকের অবস্থা ও আবহাওয়ার পরিবর্তনে এবং অভিজ্ঞতার নূতন আমদানি ও বৈচিত্র্যে রচনার পরিণতি নানা বাক নিয়েছে ও রূপ নিয়েছে ; একটা কোনো ঐকোর স্বাক্ষর তাদের সকলের মধ্যে অঙ্কিত হয়ে নিশ্চয়ই পরস্পরের আত্মীয়তার প্রমাণ দিতে থাকে । যারা বাইরে থেকে সন্ধান ও চর্চা করেন তাদের বিচারবুদ্ধির কাছে সেটা ধরা পড়ে । কিন্তু লেখকের কাছে সেটা স্পষ্ট গোচর হয় না । মনের ভিন্ন ভিন্ন ঋতুতে যখন ফুল ফোটায়, ফল ফলায়, তখন সেইটের আবেগ ও বাস্তবতাই কবির কাছে হয় একান্ত প্ৰত্যক্ষ । তার মাঝে মাঝে সময় আসে যখন ফলন যায় কমে, যখন হাওয়ার মধ্যে প্ৰাণশক্তির প্রেরণা হয় ক্ষীণ । তখন ইতস্তত যে ফসলের চিহ্ন দেখা দেয় সে আগেকার কাটা শস্যের পোড়ো বীজের অন্ধুর । এই অফলা সময়গুলো ভোলবার যোগ্য । এটা হল উদ্ধৃবৃত্তির ক্ষেত্র তাদেরই কাছে যারা ঐতিহাসিক সংগ্ৰহকর্তা । কিন্তু ইতিহাসের সম্বল আর কাব্যের সম্পত্তি এক জাতের নয় । ইতিহাস সবই মনে রাখতে চায় কিন্তু সাহিত্য অনেক ভোলে । ছাপাখানা ঐতিহাসিকের সহায় । সাহিত্যের মধ্যে আছে বাছাই করার ধর্ম, ছাপাখানা তার প্রবল বাধা । কবির রচনাক্ষেত্ৰকে তুলনা করা যেতে পারে নীহারিকার সঙ্গে । তার বিস্তীর্ণ ঝাপসা আলোর মাঝে মাঝে ফুটে উঠেছে সংহত ও সমাপ্ত সৃষ্টি । সেইগুলিই কাব্য । আমার রচনায় আমি তাদেরই স্বীকার করতে চাই । বাকি যত ক্ষীণ বাষ্পপীয় ফ্যাকগুলি যথার্থ সাহিত্যের শামিল নয় । ঐতিহাসিক জ্যোতির্বিজ্ঞানী ; বাষ্প, নক্ষত্র, ফাক, কোনোটাকেই সে বাদ দিতে চায় না । আমার আয়ু এখন পরিণামের দিকে এসেছে । আমার মতে আমার শেষ কর্তব্য হচ্ছে, যে লেখাগুলিকে মনে করি সাহিত্যের লক্ষ্যে এসে পৌচেছে তাদের রক্ষা করে বাকিগুলোকে বর্জন করা । কেননা রসসৃষ্টির সত্য পরিচয়ের সেই একমাত্র উপায় । সবা-কিছুকে নির্বিচারে রাশীকৃত করলে সমগ্রকে চেনা যায় না । সাহিত্যরচয়িতারূপে আমার চিত্তের যে একটি চেহারা আছে সেইটোকে স্পষ্ট করে প্রকাশ করা যেতে পারলেই আমার সার্থকতা । অরণ্যকে চেনাতে গেলেই জঙ্গলকে সাফ করা চাই, কুঠারের দরকার । একেবারে শ্রেষ্ঠ লেখাগুলিকে নিয়েই আঁট করে তোড়া বাধতে হবে এ কথা আমি বলি নে । একটা আদর্শ আছে সেটা নিছক পয়লা শ্রেণীর আদর্শ নয়, সেটা সাধারণ চলতি শ্রেণীর আদর্শ । তার মধ্যে পরস্পরের মূল্যের কমিবেশি আছে। রেলগাড়িতে যেমন প্রথম দ্বিতীয় তৃতীয় শ্রেণীর কামরা । তাদের রূপের ও ব্যবহারের আদর্শ ঠিক এক নয়। কিন্তু চাকায় চাকায় মিল আছে । একটা সাধারণ সমাপ্তির আদর্শ তারা সকলেই রক্ষা করেছে। যারা অসম্পূৰ্ণ, কারখানা-ঘরের বাইরে তাদের আনা উচিত হয় না । কিন্তু তারা যে অনেকে এসে পড়েছে, তা এই বইয়ের গোড়ার দিকের কবিতাগুলি দেখলে ধরা পড়বে । কুয়াশা যেমন বৃষ্টি নয়। এরাও তেমনি কবিতা নয় । ধারা পড়বেন তারা এই-সব কাচা বয়সের অকালজাত অঙ্গহীনতার নমুনা দেখে যদি হাসতে হয় তো হাসবেন, তবু একটুখানি দয়া রাখবেন মনে এই ভেবে যে, ভাগ্যক্রমে এই S 3. b)