পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (প্রথম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/১২

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

ভূমিকা SS থেকে দণ্ড হাতে তাদের শাসন চালায়, মনে করে চিরকালের মতো অপ্ৰতিহত তাদের প্রভাব । তাদের তকমা চোখ ভোলায় যাদের, তারা রসরাজ্যের বাইরের লোক, তারা রবাহুত ; এক-একটা বিশেষ রবি শুনে অভিভূত হয়, ভিড় করে । রসের প্রকৃতি হচ্ছে যাকে বলা যায় গুহাহিত, অভাবনীয়, সে কোনো বিশেষ উত্তেজিত সাময়িকতার আইনকানুনের অধীন নয় । তার প্রকাশ এবং তার লুপ্তি মানবপ্রকৃতির যে নিগৃঢ় বিশেষত্বের সঙ্গে জড়িত তা কেউ স্পষ্ট নির্ণয় করতে পারে না । স্বভাবের গহন সৃষ্টিশালার গভীর প্রেরণায় মানুষ আপন খেলনা গড়ে আবার খেলনা ভাঙে। আমরা কারিগররা তার সেই ভাঙাগড়ার লীলায় উপকরণ জুগিয়ে আসছি। কিন্তু সেগুলো নিতান্ত খেলনা নয়, সেগুলো কীর্তি, প্রত্যেকবার মানুষ এই আশা করে, নইলে তার হাত চলে না । অথচ সেইসঙ্গেই একটা নিরাসক্ত বৈরাগ্যকে রক্ষা করতে পারলেই उठा(नीं । আমার আশি বছর বয়সের সাহিত্যিক প্রয়াসকে সম্পূৰ্ণ আকারে পুঞ্জিত করবার এই যে চেষ্টা আজ দেখছি, এর মধ্যে নিশ্চিত অনুমান করছি অনেক গাথুনি আছে, যার উপরে, আগামী কালের বিস্মরণের দূত প্রত্যহ অদৃশ্য কালিতে আসন্ন লুপ্তির চিহ্ন অঙ্কিত করে চলেছে। এ সম্বন্ধে আমার মনে কোনো মোহ নেই, এবং ক্ষোভ করাও বৃথা বলে মনে করি । এই যদি সত্য হয়, তবে যে সুহৃদরা আমার রচনাগুলি রক্ষণীয় বলে গণ্য করছেন তাদের ইচ্ছাকে কী বলে সম্মান করা যায়। এ উপলক্ষে পৃথিবীতে জীববংশধারার ইতিহাস স্মরণের যোগ্য। কালের পরিবর্তিত গতির সঙ্গে অনেক জীব তাল রেখে চলতে পারে নি। প্রাণরঙ্গশালা থেকে সেই বেতালাদের সরিয়ে দেওয়া হয়েছে । কিন্তু সবাই তো সরে নি । অনেক আছে কালের সঙ্গে তাদের মিল ভাঙে নি। আজ নূতনও তাদের দাবি করে, পুরাতনও তাদের ত্যাগ করে নি । কি শিল্পকলায় কি সাহিত্যে, যদি তার যথেষ্ট প্রমাণ না থাকত তা হলে বলতে হতসৃষ্টিকর্তা মানুষের মন আপনি পিছনের রাস্তা ক্ৰমাগত পুড়িয়ে ফেলতে ফেলতেই চলেছে। কথাটা তো সত্য নয় । মানুষ সামনের দিকে যেমন অগ্রসরণ করে তেমনি অনুসরণ করে পিছনের, নইলে তার চলাই হয় না । পিছনহারা সাহিত্য বলে যদি কিছু থাকে। সে কবন্ধ, সে অস্বাভাবিক | তাই বলছি, আজ র্যারা আমার রচনাকে স্থায়ী সম্মানের রূপ দিতে প্ৰবৃত্ত হয়েছেন তারা আপন রুচি ও সংস্কৃতি -অনুসারে তার স্থায়িত্ব উপলব্ধি করেছেন । মানুষ আপনার এই উপলব্ধিকে বিশ্বাস করেই পাকা ইমারতের কাজ ফাদে, ভুল হতে পারে, কিন্তু ভুল না হওয়ার সম্ভাবনাকে মানুষ যে আস্থা করে সেই আস্থারই মূল্য বেশি। বর্তমান অনুষ্ঠানকর্তাদের সম্বন্ধে এই হচ্ছে বলবার কথা । আর আমার কথা যদি বল, আমি মনুর উপদেশ মানব— নাভিনন্দেত মরণং নাভিনন্দেত জীবিতং । যে যায় যাক, যে থাকে থাক। সেইসঙ্গে মিথ্যা বিনয়ের ভান করব না । বন্ধুরা আমার এতকালের অধ্যবসায়কে যে নিশ্চিত শ্রদ্ধার মূল্য দিতে প্ৰবৃত্ত হয়েছেন আমিও তাকে শ্রদ্ধা করে সেই দানের মধ্যে আমার শেষ পুরস্কার গ্রহণ করব । কাল তাদের ফাকি দেবে না এবং বিড়ম্বনা করবে না কবিকেও, এই কথায় সংশয় করার চেয়ে বিশ্বাস করাতে উপস্থিত লাভ, কেননা কালের দরবারে এর শেষ মীমাংসার সম্ভাবনা দূরে আছে। সবশেষে এই কথা জানিয়ে রাখছি, যারা এই গ্ৰন্থপ্রকাশের ভার নিয়েছেন তাদের দুঃসাধ্য কাজে আমি যথাসাধ্য দৃষ্টি রাখব এবং তারা আমার সমর্থনের অনুসরণ করবেন। VOO || V \SOS শ্ৰীনিকেতন () O