পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (প্রথম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/১৬

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

অবতরণিকা যে সংসারে প্রথম চোখ মেলেছিলুম। সে ছিল অতি নিভৃত । শহরের বাইরে শহরতলীর মতো, চারি দিকে প্রতিবেশীর ঘরবাড়িতে কলরবে আকাশটাকে আঁট করে বাধে নি । আমাদের পরিবার আমার জন্মের পূর্বেই সমাজের নোঙর তুলে দূরে বাধা-ঘাটের বাইরে এসে ভিড়েছিল । আচার-অনুশাসন ক্রিয়াকর্ম সেখানে সমস্তই বিরল । আমাদের ছিল মস্ত একটা সাবেক কালের বাড়ি, তার ছিল গোটকতক ভাঙা ঢাল বর্শা ও মরচে-পড়া তলোয়ার -খাটানো দেউড়ি, ঠাকুরদালান, তিন-চারটে উঠোন, সদর-অন্দরের বাগান, সংবৎসরের গঙ্গাজল ধরে রাখবার মোটা মোটা জালা-সাজানো অন্ধকার ঘর। পূর্বযুগের নানা পালপার্কণের পর্যায় নানা কলেবরে সাজে সজায় তার মধ্য দিয়ে একদিন চলাচল করেছিল, আমি তার স্মৃতিরও বাইরে পড়ে গেছি। আমি এসেছি। যখন, এ বাসায় তখন পুরাতন কাল সদ্য বিদায় নিয়েছে, নতুন কাল সবে এসে নামল, তার আসবাবপত্র তখনো এসে পৌছয় নি । এ বাড়ি থেকে এ-দেশীয় সামাজিক জীবনের স্রোত যেমন সরে গেছে তেমনি পূর্বতন ধনের স্রোতেও পড়েছে। ভাটা । পিতামহের ঐশ্বৰ্য দীপাবলী নানা শিখায় একদা এখানে দীপ্যমান ছিল, সেদিন বাকি ছিল দহনশেষের কালো দাগগুলো, আর ছাই, আর একটিমাত্র কম্পমান ক্ষীণ শিখা । প্রচুর উপকরণসমাকীর্ণ পূর্বকালের আমোদ-প্ৰমোদ-বিলাস-সমারোহের সরঞ্জাম কোণে কোণে ধূলিমলিন জীর্ণ অবস্থায় কিছু কিছু বাকি যদি বা থাকে তাদের কোনো অর্থ নেই। আমি ধনের মধ্যে জন্মাই নি, ধনের স্মৃতির মধ্যেও না । নিরালায় এই পরিবারে যে স্বাতন্ত্র্য জেগে উঠেছিল সে স্বাভাবিক, মহাদেশ থেকে দূরবিচ্ছিন্ন দ্বীপের গাছপালা জীবজন্তুরই স্বাতন্ত্র্যের মতো । তাই আমাদের ভাষায় একটা কিছু ভঙ্গি ছিল কলকাতার লোক যাকে ইশারা করে বলত ঠাকুরবাড়ির ভাষা । পুরুষ ও মেয়েদের বেশভূষাতেও তাই, চালচলনেও । বাংলা ভাষাটাকে তখন শিক্ষিতসমাজ অন্দরে মেয়েমহলে ঠেলে রেখেছিলেন ; সদরে ব্যবহার হত ইংরেজি- চিঠিপত্রে, লেখাপড়ায়, এমন-কি, মুখের কথায় । আমাদের বাড়িতে এই বিকৃতি ঘটতে পারে নি। সেখানে বাংলা ভাষার প্রতি অনুরাগ ছিল সুগভীর, তার ব্যবহার ছিল সকল কাজেই । আমাদের বাড়িতে আর-একটি সমাবেশ হয়েছিল সেটি উল্লেখযোগ্য । উপনিষদের ভিতর দিয়ে প্রাকপৌরাণিক যুগের ভারতের সঙ্গে এই পরিবারের ছিল ঘনিষ্ঠ সম্বন্ধ। অতি বাল্যকালেই প্রায় প্রতিদিনই বিশুদ্ধ উচ্চারণে অনর্গল আবৃত্তি করেছি। উপনিষদের শ্লোক । এর থেকে বুঝতে পারা যাবে সাধারণত বাংলাদেশে ধর্মসাধনায় ভাবাবেগের যে উদবোলতা আছে আমাদের বাড়িতে তা প্রবেশ করে নি । পিতৃদেবের প্রবর্তিত উপাসনা ছিল শান্ত সমাহিত । এই যেমন এক দিকে তেমনি অন্য দিকে আমার গুরুজনদের মধ্যে ইংরেজি সাহিত্যের আনন্দ ছিল নিবিড়। তখন বাড়ির হাওয়া শেকসপীয়রের নাট্যরস-সম্ভোগে আন্দোলিত, সার ওঅলটার স্কটের প্রভাবও প্রবল । দেশপ্রীতির উন্মাদনা তখন দেশে কোথাও নেই । রঙ্গলালের ”স্বাধীনতাহীনতায় কে বাচিতে চায় রে” আর তার পরে হেমচন্দ্রের “বিংশতি কোটি মানবের বাস” কবিতায় দেশমুক্তি-কামনার সুর ভোরের পাখির কাকলির মতো শোনা যায়। হিন্দুমেলার পরামর্শ ও আয়োজনে আমাদের বাড়ির সকলে তখন উৎসাহিত, তার প্রধান কর্মকর্তা ছিলেন নিবগোপাল মিত্র । এই মেলার গান ছিল মেজদাদার লেখা “জয় ভারতের জয়”, গণদাদার লেখা “লজ্জায় ভারত-যশ গাইব কী করে”, বড়দাদার “মলিন মুখচন্দ্ৰমা ভারত তোমারি” । S