পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (প্রথম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/২১

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

२०] রবীন্দ্র-রচনাবলী কলে-ঠাসা বিরহ তো আজ পর্যন্ত বাজারে নামে নি । মেঘদূতের শোকাবহ পরিণামে শোক করবে না। এমনতরো বলবান পুরুষ আজকাল দেখতে পাওয়া যাচ্ছে । কেউ কেউ বলছেন, এখন কবিতার যে আওয়াজটা শোনা যাচ্ছে সে নাভিশ্বাসের আওয়াজ । ওর সময় হয়ে এল । যদি তা সত্য হয় তবে সেটা কবিতার দোষে নয়, সময়ের দোষে । মানুষের প্রাণটা চিরদিনই ছন্দে-বাধা, কিন্তু তার কালটা কলের তাড়ায় সম্প্রতি 27-98 আঙুরের খেতে চাষি কাঠি পুঁতে দেয়, তারই উপর আঙুর লতিয়ে উঠে আশ্রয় পায়, ফল ধরায় । তেমনি জীবনযাত্রাকে সবল ও সফল করৱার জন্যে কতকগুলি রীতিনীতি বেঁধে দিতে হয় । এই রীতিনীতির অনেকগুলিই নিজীব নীরস, উপদেশ-অনুশাসনের খুঁটি । কিন্তু বেড়ায় লাগানো জিয়লকাঠের খুঁটি যেমন রস পেলেই বেঁচে ওঠে, তেমনি জীবনযাত্রা যখন প্ৰাণের ছন্দে শাস্তগমনে চলে তখন শুকনো খুঁটিগুলো অস্তরের গভীরে পৌছবার অবকাশ পেয়ে ক্রমেই প্ৰাণ পেতে থাকে । সেই গভীরেই সঞ্জীবনরস । সেই রসে তত্ত্ব ও নীতির মতো পদার্থও হৃদয়ের আপন সামগ্ৰীীরাপে সজীব ও সজিত হয়ে ওঠে, মানুষের আনন্দের রঙ তাতে লাগে । এই আনন্দের প্রকাশের মধ্যেই চিরন্তনতা । একদিনের নীতিকে, আর-একদিন আমরা গ্ৰহণ নাও করতে পারি, কিন্তু সেই নীতি যে প্রীতিকে, যে সৌন্দর্যকে, আনন্দের সত্য ভাষায় প্রকাশ করেছে। সে আমাদের কাছে নূতন থাকবে । আজও নুতন আছে মোগল সাম্রাজ্যের শিল্প- সেই সাম্রাজ্যকে, তার সাম্রাজনীতিকে আমরা পছন্দ করি আর না করি । কিন্তু যে যুগে দলে দলে গরজের তাড়ায় অবকাশ ঠাসা হয়ে নিরেট হয়ে যায় সে যুগ প্রয়োজনের, সে যুগ প্রীতির নয় । প্রীতি সময় নেয় গভীর হতে । আধুনিক এই তুরা-তাড়িত যুগে প্রয়োজনের তাগিদ কচুরিপানার মতোই সাহিত্যধারার মধ্যেও ভুরি ভুরি ঢুকে পড়েছে । তারা বাস করতে আসে না, সমস্যাসমাধানের দরখাস্ত হাতে ধন্না দিয়ে পড়ে । সে দরখাস্ত যতই অলংকৃত হোক তবু সে খাটি সাহিত্য নয়, সে দরখাস্তই । দাবি মিটলেই তার অন্তর্ধান । এমন অবস্থায় সাহিত্যের হাওয়াবদল হয় এ-বেলা ও-বেলা । কোথাও আপনি দরদ রেখে যায় না । পিছনটাকে লাথি মেরেই চলে, যাকে উচু করে গড়েছিল তাকে ধূলিসাৎ করে তার পরে মোটের উপর দীর্ঘকাল বদল হয় নি ; কেননা ওরা আমাদের অন্তরের অনুরাগকে আঁকড়ে আছে । দেখে আমাদের চোখের ক্লান্তি হয় না। হত। ক্লান্তি, মনটা যদি রাসিয়ে দেখবার উপযুক্ত সময় না পেয়ে বেদরদি ও অশ্রদ্ধাপরায়ণ হয়ে উঠত । হৃদয়হীন অগভীর বিলাসের আয়োজনে অকারণে অনায়াসে ঘন ঘন ফ্যাশনের বদল । এখনকার সাহিত্যে তেমনি রীতির বদল । হৃদয়টা দৌড়তে দৌড়তে শ্ৰীতিসম্বন্ধের রাখী গাঁথতে ও পরাতে পারে না । যদি সময় পেত সুন্দর কবে বিনিয়ে বিনিয়ে গাথত । এখন ওকে ব্যস্ত লোকেরা ধমক দিয়ে বলে, রেখে দাও তোমার সুন্দর । সুন্দর পুরোনো, সুন্দর সেকেলে । আনো একটা যেমন-তেমন-করে-পাক-দেওয়া শণের দড়িসেটাকে বলব রিয়ালিজম। এখনকার দুদ্দাড়-দীেড়ওআলা লোকের ঐটেই পছন্দ । স্বল্পায়ু হঠাৎ— নবাবের মতো উদ্ধত- তার প্রধান অহংকার এই যে, সে অধুনাতন ; অর্থাৎ তার বড়াই গুণ নিয়ে নয়, কাল নিয়ে । বেগের এই মোটর-কলটা পশ্চিমাদেশের মর্মস্থানে । ওটা এখনো পাকা দলিলে আমাদের নিজস্ব হয় নি । তবু আমাদেরও দৌড় আরম্ভ হল । ওদেরই হাওয়া-গাড়ির পায়দানের উপর লাফ দিয়ে আমরা উঠে পড়েছি। আমরাও খর্বকেশিনী খর্ববেশিনী সাহিত্যকীর্তির টেকনিকের হাল ফ্যাশন নিয়ে গভীরভাবে আলোচনা করি, আমরাও অধুনাতনের স্পর্ধা নিয়ে পুরাতনের মানহানি করতে অত্যন্ত খুশি হই।