পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (প্রথম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/২৩

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

RNR) yr রবীন্দ্ৰ-রচনাবলী নীেকায় বা মাটির গামলায় তো তার বোঝাই সইবে না। আধুনিক-কাল-বিলাসীরা অবজ্ঞার সঙ্গে বলতে পারেন এ-সব কথা আধুনিক কালের বুলির সঙ্গে মিলছে না- তা যদি হয় তা হলে সেই আধুনিক কালটারই জন্যে পরিতাপ করতে হবে । আশ্বাসের কথা এই যে, সে চিরকালই আধুনিক থাকবে এত আয়ু তার নয় । কবি যদি ক্লান্ত মনে এমন কথা মনে করে যে, কবিত্বের চিরকালের বিষয়গুলি আধুনিক কালে পুরোনো হয়ে গেছে তা হলে বুঝব আধুনিক কালটাই হয়েছে বুদ্ধ ও রসহীন । চিরপরিচিত জগতে তার সহজ অনুরাগের রস পৌঁচাচ্ছে না, তাই জগৎটাকে আপনার মধ্যে নিতে পারল না । যে কল্পনা নিজের চারি দিকে আর রস পায় না, সে যে কোনো চেষ্টাকৃত রচনাকেই দীর্ঘকাল সরস রাখতে পারবে এমন আশা করা বিড়ম্বন । রসনায় যার রুচি মরেছে চিরদিনের অন্নে সে তৃপ্তি পায় না, সেই একই কারণে কোনো একটা আজগবি অন্নেও সে চিরদিন রস পাবে এমন সম্ভাবনা নেই । আজ সত্তর বছর বয়সে সাধারণের কাছে আমার পরিচয় একটা পরিণামে এসেছে । তাই আশা করি, যারা আমাকে জানিবার কিছুমাত্র চেষ্টা করেছেন এতদিনে অন্তত তারা এ কথা জেনেছেন যে, আমি জীৰ্ণ জগতে জন্মগ্রহণ করি নি। আমি চোখ মেলে যা দেখলুম চোখ আমার কখনো তাতে ব্লকান্ত হল না । বিস্ময়ের অন্ত পাই নি । চরাচরকে বেষ্টন করে অনাদিকালের যে অনাহত বাণী অনন্তকালের অভিমুখে ধ্বনিত তাতে আমার মনপ্ৰাণ সাড়া দিয়েছে, মনে হয়েছে যুগে যুগে এই বিশ্ববাণী শুনে এলুম । সৌরমণ্ডলীর প্রান্তে এই আমাদের ছোটাে শ্যামলা পৃথিবীকে ঋতুর আকাশদূতগুলি বিচিত্র রসের বর্ণসজ্জায় সাজিয়ে দিয়ে যায়, এই আদরের অনুষ্ঠানে আমার হৃদয়ের অভিষেকবরি নিয়ে যোগ দিতে কোনোদিন আলস্যা করি নি । প্রতিদিন উযাকালে অন্ধকার রাত্রির প্রান্তে স্তব্ধ হয়ে দাড়িয়েছি। এই কথাটি উপলব্ধি করবার জন্যে যে, যত্তে রূপং কল্যাণতমং তত্ত্বে পশ্যামি । আমি সেই বিরাট সত্তাকে আমার অনুভবে স্পর্শ করতে চেয়েছি। যিনি সকল সত্তার আত্মীয়সম্বন্ধের ঐক্যতত্ত্ব ; যার খুশিতেই নিরন্তর অসংখ্যরূপের প্রকাশে বিচিত্ৰভাবে আমার প্রাণ খুশি হয়ে উঠেছে— বলে উঠছে- কোহ্যেবানাৎ কঃ প্ৰাণ্যাৎ যদোষ আকাশ আনন্দো ন স্যাৎ ; যাতে কোনো প্ৰয়োজন নেই। তাও আনন্দের টানে টানবে, এই অত্যাশ্চর্য ব্যাপারের চরম অর্থ যার মধ্যে ; যিনি অন্তরে অন্তরে মানুষকে পরিপূর্ণ করে বিদ্যমান বলেই প্ৰাণপণ কঠোর আত্মত্যাগকে আমরা আত্মঘাতী পাগলের পাগলামি বলে হেসে উঠলুম କN | ঈশোপনিষদের প্রথম যে মন্ত্রে পিতৃদেব দীক্ষা পেয়েছিলেন সেই মন্ত্রটি বারবার নতুন নতুন অর্থ নিয়ে আমার মনে আন্দোলিত হয়েছে, বারবার নিজেকে বলেছি- তেন ত্যক্তেন ভুঞ্জীথাঃ, মা গৃধঃ । আনন্দ করো তাই নিয়ে যা তোমার কাছে সহজে এসেছে— যা রয়েছে তোমার চার দিকে তারই মধ্যে চিরন্তন- লোভ কোরো না । কাব্যসাধনায় এই মন্ত্র মহামূল্য । আসক্তি যাকে মাকড়সার মতো জালে জড়ায় তাকে জীৰ্ণ করে দেয় ; তাতে গ্রানি আসে, ক্লান্তি আনে । কেননা, আসক্তি তাকে সমগ্র থেকে উৎপাটন করে নিজের সীমার মধ্যে বাধে- তার পরে তোলা ফুলের মতো অল্পক্ষণেই সে স্নান হয় । মহৎ সাহিত্য ভোগকে লোভ থেকে উদ্ধার করে, সৌন্দর্যকে আসক্তি থেকে, চিত্তকে উপস্থিত গরজের দণ্ডধারীদের কাছ থেকে । রাবণের ঘরে সীতা লোভের দ্বারা বন্দী ; রামের ঘরে সীতা প্রেমের দ্বারা মুক্ত, সেখানেই তার সত্য প্রকাশ । প্রেমের কাছে দেহের অপরূপ রূপ প্রকাশ পায়, লোভের কাছে তার স্থূল মাংস । অনেক দিন থেকেই লিখে আসছি, জীবনের নানা পর্বে নানা অবস্থায় । শুরু করেছি। কাচা বয়সে- তখনো নিজেকে বুঝি নি। তাই আমার লেখার মধ্যে বাহুল্য এবং বর্জনীয় জিনিস ভুরি ভুরি আছে তাতে সন্দেহ নেই। এ-সমস্ত আবর্জনা বাদ দিয়ে বাকি যা থাকে আশা করি তার