পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (প্রথম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/২৪

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

অবতরণিকা ] ܘܓ মধ্যে এই ঘোষণাটি স্পষ্ট যে, আমি ভালোবেসেছি। এই জগৎকে, আমি প্ৰণাম করেছি। মহৎকে, আমি কামনা করেছি। মুক্তিকে- যে মুক্তি পরমপুরুষের কাছে আত্মনিবেদনে, আমি বিশ্বাস করেছি মানুষের সত্য সেই মহামানবের মধ্যে যিনি সদা জনানাং হৃদয়ে সন্নিবিষ্টঃ । আমি আবাল্য-অভ্যস্ত ঐকান্তিক সাহিত্য-সাধনার গণ্ডিকে অতিক্রম করে একদা সেই মহামানবের উদ্দেশে যথাসাধ্য আমার কমের অর্ঘ্য আমার ত্যাগের নৈবেদ্য আহরণ করেছি- তাতে বাইরের থেকে যদি বাধা পেয়ে থাকি অস্তরের থেকে পেয়েছি প্ৰসাদ । আমি এসেছি। এই ধরণীর মহাতীৰ্থে- এখানে সর্বদেশ সর্বজাতি ও সর্বকালের ইতিহাসের মহাকেন্দ্ৰে আছেন নরদেবতাতারই বেদীমূলে নিভৃতে বসে আমার অহংকার আমার ভেদবুদ্ধি ক্ষালন করবার দুঃসাধ্য চেষ্টায় আজও প্রবৃত্ত আছি। আমার যা-কিছু অকিঞ্চিৎকর তাকে অতিক্রম করেও যদি আমার চরিত্রের অস্তবতম প্রকৃতি ও সাধনা লেখায় প্রকাশ পেয়ে থাকে, আনন্দ দিয়ে থাকে, তবে তার পরিবর্তে আমি প্রীতি কামনা করি, আর-কিছু নয় । এ কথা যেন জেনে যাই, অকৃত্রিম সৌহার্দা পেয়েছি সেই তাদের কাছে যারা আমার সমস্ত ক্ৰটি সত্ত্বেও জেনেছেন সমস্ত জীবন আমি কী চেয়েছি, কী পেয়েছি, কী দিয়েছি, আমার অপূৰ্ণ জীবনে অসমাপ্ত সাধনায় কী ইঙ্গিত আছে । সাহিত্যে মানুষের অনুরাগসম্পদ সৃষ্টি করাই যদি কবির যথার্থ কাজ হয়, তবে এই দান গ্রহণ করতে গেলে প্রীতিরই প্রয়োজন । কেননা, প্রীতিই সমগ্র করে দেখে । আজ পর্যন্ত সাহিত্যে যারা সম্মান পেয়েছেন তাদের রচনাকে আমরা সমগ্রভাবে দেখেই শ্রদ্ধা অনুভব করি । তাকে টুকরো টুকরো ছিড়ে ছিড়ে ছিদ্রসন্ধান বা ছিদ্রখনন করতে স্বভাবত প্রবৃত্তি হয় না । জগতে আজ পর্যন্ত অতিবড়ো সাহিত্যিক এমন কেউ জন্মায় নি, অনুরাগবঞ্চিত পারুষ চিত্ত নিয়ে যার শ্রেষ্ঠ রচনাকেও বিদ্রুপ করা, তার কদৰ্থ করা, তার প্রতি অশোভন মুখবিকৃতি করা, যে-কোনো মানুষ না পারে । প্রীতির প্রসন্নতাই সেই সহজ ভূমিকা, যার উপরে কবির সৃষ্টি সমগ্র হয়ে সুস্পষ্ট হয়ে প্রকাশমান হয় । মর্তলোকের শ্রেষ্ঠ দান এই প্রীতি আমি পেয়েছি। এ কথা প্ৰণামের সঙ্গে বলি । পেয়েছি পৃথিবীর অনেক বরণীয়দের হাত থেকে— তাদের কাছে কৃতজ্ঞতা নয়, আমার হৃদয় নিবেদন করে দিয়ে গেলেম । তাদের দক্ষিণ হাতের সম্পর্শে বিরাট মানবেরই স্পর্শ লেগেছে আমার ললাটে ; আমার যা-কিছু শ্রেষ্ঠ তা তাদের গ্রহণের যোগ্য হোক । আর আমার স্বদেশের লোক র্যারা অতিনিকটের অতিপরিচয়ের অস্পষ্টতা ভেদ করেও আমাকে ভালোবাসতে পেরেছেন আজ এই অনুষ্ঠানে তাদেরই বহুযত্বরচিত অর্ঘ্য সজ্জিত । তাদের সেই ভালোবাসা হৃদয়ের সঙ্গে গ্রহণ করি ।