পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (প্রথম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬৪১

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

বউ-ঠাকুরানীর হাট W9 OS সমস্ত শুভ্ৰকে কালি করিলে ? দিনকে রাত্রি করিলে ? আমার হৃদয়ের পুষ্পবনে মালতী ও জুই ফুলের ৬ মুখগুলিও যেন লজ্জায় কালো হইয়া গেল।” - বলিতে বলিতে উদয়াদিত্যের গীেরবর্ণ মুখ রক্তবর্ণ হইয়া উঠিল, আয়ত নেত্র অধিকতর বিস্ফারিত হইয়া উঠিল, মাথা হইতে পা পর্যন্ত একটি বিদ্যুৎশিখা কঁপিয়া উঠিল । সুরমা হর্ষে গর্বে, কষ্টে কহিল, “আমার মাথা খাও, ও কথা থাক।” উদয়াদিত্য । ধীরে ধীরে যখন রক্ত শীতল হইয়া গেল। সকলই তখন যথাযথ পরিমাণে দেখিতে পাইলাম। যখন জগৎকে উষ্ণ, ঘূর্ণিতমস্তিষ্ক, রক্তনয়ন মাতালের কুজ্বাটিকাময় ঘূর্ণমান স্বপ্নদৃশ্য বলিয়া মনে না হইয়া প্রকৃত কার্যক্ষেত্ৰ বলিয়া মনে হইল, তখন মনের কী অবস্থা ! কোথা হইতে কোথায় পতন ! শত সহস্ৰ লক্ষ ক্রোশ পাতালের গহবরে, অন্ধ অন্ধতর অন্ধতম রজনীর মধ্যে একেবারে পলক না ফেলিতে পড়িয়া গেলাম। দাদামহাশয় স্নেহভরে ডাকিয়া লইয়া গেলেন ; তাহার কাছে মুখ দেখাইলাম কী বলিয়া ? কিন্তু সেই অবধি আমাকে রায়গড় ছাড়িতে হইল । দাদামহাশয় আমাকে না। দেখিলে থাকিতে পারেন না ; আমাকে ডাকিয়া পাঠাইতেন । আমার এমনি ভয় করিত যে, আমি কোনোমতেই যাইতে পারিতাম না । তিনি স্বয়ং আমাকে ও ভগিনী বিভাকে দেখিতে আসিতেন । অভিমান নাই, কিছুই নাই | জিজ্ঞাসাও করিতেন না, কেন যাই নাই । আমাদের দেখিতেন, আমোদ-উল্লাস করিতেন ও চলিয়া যাইতেন । উদয়াদিত্য ঈষৎ হাস্য করিয়া অতিশয় মৃদু কোমল প্রেমে তাহার বড়ো বড়ো চােখ দুটি প্লাবিত করিয়া সুরমার মুখের দিকে চাহিলেন । সুরমা বুঝিল, এইবার কী কথা আসিতেছে । মুখ নত হইয়া আসিল ; ঈষৎ চঞ্চল হইয়া পড়িল । যুবরাজ দুই হস্তে তাহার দুই কপোল ধরিয়া নত মুখখানি তুলিয়া ধরিলেন । অধিকতর নিকটে গিয়া বসিলেন ; মুখখানি নিজের স্কন্ধে ধীরে ধীরে রাখিলেন । কটিদেশ বামহস্তে বেষ্টন করিয়া ধরিলেন ও গভীর প্রশান্ত প্রেমে তাহার কপোল চুম্বন করিয়া বলিলেন, “তার পর কী হইল, সুরমা বলো দেখি । এই বুদ্ধিতে দীপ্যমান, স্নেহ প্রেমে কোমল, হাস্যে উজ্জ্বল ও প্রশান্ত ভাবে বিমল, মুখখানি কোথা হইতে উদয় হইল ? আমার সে গভীর অন্ধকার ভাঙিবে আশা ছিল কি ? তুমি আমার উষা, আমার আলো, আমার আশা, কী মায়ামস্ত্রে সে আঁধার দূর করিলে।” যুবরাজ বার বার সুরমার মুখচুম্বন করিলেন । সুরমা কিছুই কথা কহিল না, আনন্দে তাহার চোখ জলে পুরিয়া আসিল । যুবরাজ কহিলেন, “এতদিনের পরে আমি যথার্থ আশ্রয় পাইলাম । তোমার কাছে প্ৰথম শুনিলাম যে আমি নির্বোধী নই, তাহাঁই বিশ্বাস করিলাম, তাহাঁই বুঝিতে পারিলাম । তোমারই কাছে শিখিলাম বুদ্ধি অন্ধকারময় ক্ষুদ্র গলির মতো বঁকাচােরা উচুনিচু নহে, রাজপথের ন্যায় সরল সমতল প্রশস্ত। পূর্বে আমি আপনাকে ঘূণা করিতাম, আপনাকে অবহেলা করিতাম । কোনাে কাজ করিতে সাহস করিতাম না । মন যদি বলিত ইহাই ঠিক, আত্মসংশয়ী সংস্কার বলিত উহা ঠিক না। হইতেও পারে । যে যেরূপ ব্যবহার করিত তাহাই সহিয়া থাকি,তাম, নিজে কিছু ভাবিতে চেষ্টা করিতাম না । এতদিনের পরে আমার মনে হইল, আমি কিছু, আমি কেহ । এতদিন আমি অগোচর ছিলাম, তুমি আমাকে বাহির করিয়াছ, সুরমা, তুমি আমাকে আবিষ্কার করিয়াছ, এখন আমার মনে যাহা ভালো বলে তৎক্ষণাৎ তাহা আমি সাধন করিতে চাই । তোমার উপর আমার এমন বিশ্বাস আছে যে, তুমি যখন আমাকে বিশ্বাস কর তখন আমিও আমাকে নিৰ্ভয়ে বিশ্বাস করিতে পারি। ঐ সুকুমার শরীরে এত বল কোথায় ছিল যাহাতে আমাকেও তুমি বলীয়ান করিয়া তুলিয়াছ!” কী অপরিসীম নির্ভরের ভাবে সুরমা স্বামীর বক্ষ বেষ্টন করিয়া ধরিল। কী সম্পূৰ্ণ আত্মবিসজী দৃষ্টিতে র্তাহার মুখের দিকে চাহিয়া রহিল। তাহার চােখ কহিল, “আমার আর কিছুই নাই কেবল তুমি আছ, তাই আমার সব আছে!” এক-একদিন নিস্তব্ধ গভীর রাত্রে সুরমার নিকট সেই শতবার-কথিত পুরানো জীবনকাহিনী খণ্ডে খণ্ডে সোপানে সোপানে আলোচনা করিতে র্তাহার বড়ো ভালো লাগে । S \OS