পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (প্রথম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬৪২

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

NNS O রবীন্দ্র-রচনাবলী উদয়াদিত্য কহিলেন, “এমন করিয়া আর কতদিন চলিবে সুরমা ? এ দিকে রাজসভায় সভাসদগণ কেমন একপ্রকার কৃপাদৃষ্টিতে আমার প্রতি চায়, ও দিকে অন্তঃপুরে মা তোমাকে লাঞ্ছনা করিতেছেন। দাসদাসীরা পর্যন্ত তোমাকে তেমন মানে না। আমি কাহাকেও ভালো করিয়া কিছু বলিতে পারি না, চুপ করিয়া থাকি, সহ্য করিয়া যাই । তোমার তেজস্বী স্বভাব, কিন্তু তুমিও নীরবে সহিয়া যাও । যখন তোমাকে সুখী করিতে পারিলাম না, আমা হইতে কেবল তোমাকে অপমান আর কষ্টই সহ্য করিতে হইল, তখন আমাদের এই বিবাহ না হইলেই ভালো ছিল ।” সুরমা । সে কী কথা নাথ ! এই সময়েই তো সুরমাকে আবশ্যক । সুখের সময় আমি তোমার কী করিতে পারিতাম ! সুখের সময় তো সুরমা বিলাসের দ্রব্য, খেলিবার জিনিস। সকল দুঃখ অতিক্রম করিয়া আমার মনে এই সুখ জাগিতেছে যে, আমি তোমার কাজে লাগিতেছি, তোমার জন্য দুঃখ সহিতে যে অতুল আনন্দ আছে সেই আনন্দ উপভোগ করিতেছি । কেবল দুঃখ এই, তোমার সমৃদয় কষ্ট কেন আমি বহন করিতে পারিলাম না । যুবরাজ কিয়ৎক্ষণ চুপ করিয়া থাকিয়া কহিলেন, “আমি নিজের জন্য তেমন ভাবি না । সকলই সহিয়া গিয়াছে কিন্তু আমার জন্য তুমি কেন অপমান সহ্য করিবে ? তুমি যথার্থ স্ত্রীর মতো আমার দুঃখের সময় সান্তনা দিয়াছ, শ্রান্তির সময় বিশ্রাম দিয়াছ, কিন্তু আমি স্বামীর মতো তোমাকে অপমান হইতে, লজ্জা হইতে রক্ষা করিতে পারিলাম না । তোমার পিতা শ্ৰীপুররাজ আমার পিতাকে প্রধান বলিয়া না মানাতে, আপনাকে যশোহরছত্রের অধীন বলিয়া স্বীকার না করাতে, পিতা তোমার প্রতি অবহেলা দেখাইয়া নিজের প্রধানত্ব বজায় রাখিতে চান | তোমাকে কেহ অপমান করিলে তিনি কানেই আনেন না । তিনি মনে করেন, তোমাকে যে পুত্রবধূ করিয়াছেন, ইহাই তোমার পক্ষে যথেষ্ট । এক-একবার মনে হয়। আর পারিয়া উঠি না, সমস্ত পরিত্যাগ করিয়া তোমাকে লইয়া চলিয়া যাই । এতদিনে হয়তো যাইতাম, তুমি কেবল আমাকে ধরিয়া রাখিয়ােছ।” রাত্ৰি গভীর হইল । অনেকগুলি সন্ধ্যার তারা অস্ত গেল, অনেকগুলি গভীর রাত্রের তারা উদিত হইল । প্রাকারতোরণস্থিত প্রহরীদের পদশব্দ দূর হইতে শুনা যাইতেছে। সমুদয় জগৎ সুষুপ্ত । নগরের সমুদয় প্ৰদীপ নিবিয়া গিয়াছে, গৃহদ্বার রুদ্ধ, দৈবাৎ দু-একটা শৃগাল ছাড়া একটি জনপ্ৰাণীও নাই । উদয়াদিত্যের শয়নকক্ষের দ্বার রুদ্ধ ছিল । সহসা বাহির হইতে কে দুয়ারে আঘাত করিতে লাগিল । শশব্যস্ত যুবরাজ দুয়ার খুলিয়া দিলেন, “কেন বিভা ? কী হইয়াছে ? এত রাত্রে এখানে আসিয়াছ কেন ?” পাঠকেরা পূর্বেই অবগত হইয়াছেন বিভা উদয়াদিত্যের ভগিনী । বিভা কহিল, “এতক্ষণে বুঝি সর্বনাশ হইল !” স্বরে চুপি চুপি কী কহিল । বলিতে বলিতে আর থাকিতে পারিল না, কাদিয়া উঠিল ; কহিল, “দাদা, কী হইবে ?” বিভা বলিয়া উঠিল, “না না, তুমি যাইয়ো না ।” উদয়াদিত্য । কেন বিভা ? বিভা ৷ পিতা যদি জানিতে পারেন ? তোমার উপরে যদি রাগ করেন ? সুরমা কহিল, “ছিঃ বিভা, এখন কি তাহা ভাবিবার সময় ?” উদয়াদিত্য বস্ত্ৰাদি পরিয়া কটিবন্ধে তরবারি বাধিয়া প্ৰস্থানের উদযোগ করিলেন । বিভা তাহার হাত ধরিয়া কহিল, “দাদা, তুমি যাইয়ো না, তুমি লোক পাঠাইয়া দাও, আমার বড়ো ভয় করিতেছে।” উদয়াদিত্য কহিলেন, “বিভা, এখন বাধা দিস নে ; আর সময় নাই৷ ” এই কথা বলিয়া তৎক্ষণাৎ বাহির হইয়া গেলেন । বিভা সুরমার হাত ধরিয়া কহিল, “কী হইবে ভাই ? বাবা যদি টের পান ?”