পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (প্রথম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬৪৪

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

"> ミ রবীন্দ্র-রচনাবলী যায় ; আমার ইচ্ছা যায় রায়বংশের ক্ষত, বঙ্গদেশের ক্ষত ঐ বসন্ত রায়কে কাটিয়া ফেলিয়া বায়বংশকে বঁাচাই, বঙ্গদেশকে বাচাই । মন্ত্রী কহিলেন, “এ বিষয়ে মহারাজের সহিত আমার অন্য মত ছিল না ।” প্রতাপাদিত্য কহিলেন, “হী ছিল । ঠিক কথা বলে । এখনো আছে । দেখো মন্ত্রী, যতক্ষণ আমার মতের সহিত তোমার মত না মিলিবে, ততক্ষণ তাহা প্ৰকাশ করিয়ো । সে সাহস যদি না থাকে। তবে এ পদ তোমার নহে। সন্দেহ থাকে তো বলিয়ো । আমাকে বুঝাইবার অবসর দিয়ে । তুমি মনে করিতেছ নিজের পিতৃব্যকে হনন করা সকল সময়েই পাপ ; ‘না’ বলিয়ে না, ঠিক এই কথাই তোমার মনে জাগিতেছে । ইহার উত্তর আছে। পিতার অনুরোধে ভৃগু নিজের মাতাকে বধ করিয়াছিলেন, ধর্মের অনুরোধে আমি আমার পিতৃব্যকে বধ করিতে পারি না ?” এ বিষয়ে— অর্থাৎ ধর্ম অধৰ্ম বিষয়ে যথার্থই মন্ত্রীর কোনো মতামত ছিল না । মন্ত্রী যতদূর তলাইয়াছিলেন, রাজা ততদূর তলাইতে পারেন নাই। মন্ত্রী বিলক্ষণ জানিতেন যে, উপস্থিত বিষয়ে তিনি যদি সংকোচ দেখান তাহা হইলে রাজা। আপাতত কিছু রুষ্ট হইবেন বটে, কিন্তু পরিণামে তাহার জন্য মনে মনে সন্তুষ্ট হইবেন । এইরূপ না করিলে মন্ত্রীর বিরুদ্ধে এককালে-না-এককালে রাজার সন্দেহ ও আশঙ্কা জন্মিতে পারে । মন্ত্রী কহিলেন, “আমি বলিতেছিলাম কি, দিল্লীশ্বর এ সংবাদ শুনিয়া নিশ্চয়ই রুষ্ট হইবেন ।” দিল্লীশ্বর তো আমার ঈশ্বর নহেন । তিনি রুষ্ট হইলে থরথর করিয়া কঁাপিতে থাকিবে এমন জীব যথেষ্ট আছে, মানসিংহ আছে বীরবল আছে, আমাদের বসন্ত রায় আছেন, আর সম্প্রতি দেখিতেছি। তুমিও আছে ; কিন্তু আত্মবৎ সকলকে মনে করিয়ো না ।” মন্ত্রী হাসিয়া কহিলেন, “আজ্ঞা, মহারাজ, ফাকা রোষকে আমিও বড়ো একটা ডরাই না, কিন্তু তাহার সঙ্গে সঙ্গে ঢাল-তলোয়ার যদি থাকে তাহা হইলে ভাবিতে হয় বৈকি । দিল্লীশ্বরের রোষের অর্থ পঞ্চাশ সহস্র সৈন্য ।” ' প্রতাপাদিত্য ইহার একটা সদুত্তর না দিতে পারিয়া কহিলেন, “দেখো মন্ত্রী, দিল্লীশ্বরের ভয় দেখাইয়া আমাকে কোনো কাজ হইতে নিরস্ত করিতে চেষ্টা করিয়ো না, তাহাতে আমার নিতান্ত অপমান বোধ হয় ।” মন্ত্রী কহিলেন, “প্রজারা জানিতে পারিলে কী বলিবে ?” প্ৰতাপ । জানিতে পারিলে তো ? মন্ত্রী । এ কাজ অধিকদিন চাপা রহিবে না । এ সংবাদ রাষ্ট্র হইলে সমস্ত বঙ্গদেশ আপনার বিরোধী হইবে । যে উদ্দেশ্যে এই কাজ করিতে চান, তাহা সমলে বিনাশ পাইবে । আপনাকে জাতিচ্যুত করিবে ও বিবিধ নিগ্ৰহ সহিতে হইবে । প্ৰতাপ । দেখো মন্ত্রী, আবার তোমাকে বলিতেছি, আমি যাহা করি তাহা বিশেষ ভাবিয়া করি । অতএব আমি কাজে প্ৰবৃত্ত হইলে মিছামিছি কতকগুলা ভয় দেখাইয়া আমাকে নিরস্ত করিতে চেষ্টা করিয়ো না, আমি শিশু নাহি । প্ৰতি পদে আমাকে বাধা দিবার জন্য, তোমাকে আমার নিজের শৃঙ্খলস্বরূপে রাখি নাই । মন্ত্রী চুপ করিয়া গেলেন । তাহার প্রতি রাজার দুইটি আদেশ ছিল । এক যতক্ষণ মতের অমিল হইবে ততক্ষণ প্ৰকাশ করিবে ; দ্বিতীয়ত বিরুদ্ধ মত প্ৰকাশ করিয়া রাজাকে কোনো কাজ হইতে নিরস্ত করিবার চেষ্টা করিবে না । মন্ত্রী আজ পর্যন্ত এই দুই আদেশের ভালোরূপ সামঞ্জস্য করিতে পারেন নাই । মন্ত্রী কিয়ৎক্ষণ পরে আবার কহিলেন, “মহারাজ, দিল্লীশ্বর—” প্রতাপাদিত্য জ্বলিয়া উঠিয়া কহিলেন, “আবার দিল্লীশ্বর ? মন্ত্রী, দিনের মধ্যে তুমি যতবার দিল্লীশ্বরের নাম কর ততবার যদি জগদীশ্বরের নাম করিতে তাহা হইলে পরকালের কাজ গুছাইতে পারিতে ৷ যতক্ষণে না আমার এই