পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (প্রথম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬৫২

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

Web SRO রবীন্দ্র-রচনাবলী মন্ত্রী। ইতিপূর্বে আপনি প্রকাশ্যভাবে আপনার পিতৃব্যের প্রতি দ্বেষ প্রকাশ করিয়াছেন। আপনার কন্যার বিবাহের সময় আপনি বসন্ত রায়কে নিমন্ত্রণ করেন নাই, তিনি স্বয়ং অনিমন্ত্রিত আসিয়া উপস্থিত হইয়াছিলেন । আজ আপনি সহসা বিনা কারণে র্তাহাকে নিমন্ত্রণ করিলেন ও পথের মধ্যে কে তাহাকে হত্যা করিল। এমন অবস্থায় প্রজারা আপনাকেই এই ঘটনাটির মূল বলিয়া জানিবে। প্রতাপাদিত্য রুষ্ট হইয়া কহিলেন, “তোমার ভাব আমি কিছুই বুঝিতে পারি না মন্ত্রী । এই কথাটা প্রকাশ হইলেই তুমি যেন খুশি হও, আমার নিন্দা রটিলেই তোমার যেন মনস্কামনা পূর্ণ হয় । নহিলে দিনরাত্ৰি তুমি কেন বলিতেছ যে, কথাটা প্রকাশ হইবেই। প্রকাশ হইবার আমি তো কোনো কারণ দেখিতেছি না । বোধ করি, আর কিছুতেই সংবাদটা রাষ্ট্র না হইলে তুমি নিজে গিয়া দ্বারে দ্বারে প্রকাশ করিয়া বেড়াইবে ।” মন্ত্রী কহিলেন, “মহারাজ, মার্জনা করিবেন । আপনি আমার অপেক্ষা সকল বিষয়েই অনেক ভালো বুঝেন । আপনাকে মন্ত্রণা দেওয়া আমাদের মতো ক্ষুদ্রবুদ্ধি লোকের পক্ষে অত্যন্ত স্পর্ধার বিষয় । তবে আপনি নাকি আমাকে বাছিয়া মন্ত্রী রাখিয়াছেন, এই সাহসেই ক্ষুদ্ৰ বুদ্ধিতে যাহা মনে হয় আপনাকে মাঝে মাঝে বলিয়া থাকি । মন্ত্রণায় রুষ্ট হন যদি তবে এ দাসকে এ কার্যভার হইতে অব্যাহতি দিন ।” প্রতাপাদিত্য সিধা হইলেন । মাঝে মাঝে মন্ত্রী যখন তঁহাকে দুই-একটা শক্ত কথা শুনাইয়া দেন, তখন প্রতাপাদিত্য মনে মনে সন্তুষ্ট হন । প্রতাপাদিত্য কহিলেন, “আমি বিবেচনা করিতেছি, ঐ পাঠান দুটাকে মারিয়া ফেলিলে এ বিষয়ে আর কোনো ভয়ের কারণ থাকিবে না ।” মন্ত্রী কহিলেন, “একটা খুন চাপিয়া রাখাই দায়, তিনটা খুন সামলানো অসম্ভব । প্রজারা জানিতে পরিবেই।” মন্ত্রী বরাবর নিজের কথা বজায় রাখিলেন । প্রতাপাদিত বলিয়া উঠিলেন, “তবে তো আমি ভয়ে সারা হইলাম ! প্ৰজারা জানিতে পরিবে ! যশোহর রায়গড় নহে ; এখানে প্রজাদের রাজত্ব নাই । এখানে রাজা ছাড়া আর বাকি সকলেই রাজা নহে । অতএব আমাকে তুমি প্রজার ভয় দেখাইয়ো না । যদি কোনো প্ৰজা এ বিষয়ে আমার বিরুদ্ধে কোনো কথা কহে, তবে তাহার জিহবা তপ্ত লীেহা দিয়া পুড়াইব ।” মন্ত্রী মনে মনে হাসিলেন । মনে মনে কহিলেন- প্ৰজার জিহবাকে এত ভয় ! তথাপি মনকে প্ৰবোধ দিয়া থাকেন যে, কোনো প্ৰজাকে ডরাই না ! প্রতাপাদিত্য । শ্ৰাদ্ধশান্তি শেষ করিয়া লোকজন লইয়া একবার রায়গড়ে যাইতে হইবে । আমি ছাড়া সেখানকার সিংহাসনের উত্তরাধিকারী আর তো কাহাকেও দেখিতেছি না । বৃদ্ধ বসন্ত রায় ধীরে ধীরে গৃহমধ্যে প্রবেশ করিলেন— প্রতাপাদিত্য চমকিয়া পিছু হটিয়া গেলেন । সহসা তাহার মনে হইল, বুঝি উপদেবতা । অবাক হইয়া একটি কথাও বলিতে পারিলেন না । বসন্ত রায় নিকটে গিয়া তাহার গায়ে হাত বুলাইয়া মৃদুস্বরে কহিলেন, “আমাকে কিসের ভয় প্ৰতাপ ? আমি তোমার পিতৃব্য । তাহাতেও যদি বিশ্বাস না হয়, আমি বৃদ্ধ, তোমার অনিষ্ট করিতে পারি এমন শক্তি আমার নাই ।” প্রতাপাদিত্যের চৈতন্য হইয়াছে, কিন্তু কথা বানাইয়া বলিতে তিনি নিতান্ত অপটু ৷ নিরুত্তর হইয়া অবাক হইয়া দাড়াইয়া রহিলেন । পিতৃব্যকে প্ৰণাম করা পর্যন্ত হইল না । বসন্ত রায় আবার ধীরে ধীরে কহিলেন, “প্ৰতাপ, একটা যাহা হয় কথা কও । যদি দৈবাৎ এমন একটা কাজ করিয়া থাক, যাহাতে আমাকে দেখিয়া তোমার লজ্জা ও সংকোচ উপস্থিত হয়, তবে তাহার জন্য ভাবিয়ো না । আমি কোনো কথা উত্থাপন করিব না । এসে বৎস, দুইজনে একবার কোলাকুলি করি। আজ অনেকদিনের পর দেখা হইয়াছে ; আর তো অধিক দিন দেখা হইবে না।” এতক্ষণের পর প্রতাপাদিত্য প্ৰণাম করিলেন ও উঠিয়া পিতৃব্যের সহিত কোলাকুলি করিলেন । ইতিমধ্যে মন্ত্রী আস্তে আস্তে গৃহ হইতে বাহির হইয়া-গেছেন । বসন্ত রায় ঈষৎ কোমল হাস্য হাসিয়া প্রতাপাদিত্যের গায়ে হাত দিয়া কহিলেন, “বসন্ত রায় অনেকদিন বাচিয়া আছে- না প্ৰতাপ ? সময়