পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (প্রথম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬৫৪

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

রবীন্দ্র-রচনাবলী ܓ ܓ2ܠ উদয়াদিত্যের প্রশান্ত ললাটে ঘর্মবিন্দু দেখা দিল । তাহার মনের অধীরতা পাছে প্ৰকাশ হইয়া পড়ে, একজন পুরানো বৃদ্ধা দাসী বসিয়া ছিল, সে হাত নাড়িয়া বলিয়া উঠিল, “শ্ৰীপুরের মেয়েরা জাদু জানে। নিশ্চয় বাছাকে ওষুধ করিয়াছে।” এই বলিয়া, উঠিয়া উদয়াদিত্যের কাছে গিয়া বলিল, “বাবা, ও তোমাকে ওষুধ করিয়াছে। ঐ যে মেয়েটি দেখিতেছি, উনি বড়ো সামান্য মেয়ে নন। শ্ৰীপুরের ঘরের মেয়ে । ওরা ডাইনী ! আহা, বাছার শরীরে আর কিছু রাখিল না ।” এই বলিয়া সে সুরমার দিকে তীরের মতো এক কটাক্ষ বর্ষণ করিল ও আঁচল দিয়া দুই হস্তে দুই শুষ্ক চক্ষু রাগড়াইয়া লাল করিয়া তুলিল। তাহা দেখিয়া আবার মহিষীর দুঃখ একেবারে উথলিয়া উঠিল । অন্তঃপুরে বৃদ্ধাদের মধ্যে ক্ৰন্দনের সংক্রামকতা ব্যাপ্ত হইয়া পড়িল । কঁদিবার অভিপ্ৰায়ে সকলে রানীর ঘরে আসিয়া সমবেত হইল । উদয়াদিত্য করুণনেত্রে একবার সুরমার মুখের দিকে চাহিলেন । ঘোমটার মধ্য হইতে সুরমা তাহা দেখিতে পাইল ও চোখ মুছিয়া একটি কথা না কহিয়া ধীরে ধীরে ঘরে চলিয়া গেল । সন্ধ্যাবেলা মহিষী প্রতাপাদিত্যকে কহিলেন, “আজ উদয়কে সমস্ত বুঝাইয়া বলিলাম। বাছা আমার তেমন নহে। বুঝাইয়া বলিলে বুঝে । আজ তাহার চোখ ফুটিয়াছে।” ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ বিভার স্নান মুখ দেখিয়া সুরমা আর থাকিতে পারিল না, তাহার গলা ধরিয়া কহিল, “বিভা, তুই চুপ করিয়া থাকিস কেন ? তোর মনে যখন যাহা হয় বলিস না কেন ?” বিভা ধীরে ধীরে কহিল, “আমার আর কী বলিবার আছে ?” সুরমা কহিল, “অনেকদিন তাহাকে দেখিস নাই, তোর মন কেমন করিবেই তো ! তুই তীহাকে আসিবার জন্য একখানা চিঠি লেখ-না। আমি তোর দাদাকে দিয়া পাঠাইবার সুবিধা করিয়া দিব ।” বিভার স্বামী চন্দ্ৰদ্বীপপতি রামচন্দ্র রায়ের সম্বন্ধে কথা হইতেছে । বিভা, ঘাড় হেঁট করিয়া কহিতে লাগিল, “এখানে কেহ যদি তাহাকে গ্রাহ্য না করে, কেহ যদি তাহাকে ডাকিবার আবশ্যক বিবেচনা না করে, তবে এখানে তিনি না আসিলেই ভালো । তিনি যদি আপনি আসেন। তবে আমি বারণ করিব । তিনি রাজা, যেখানে তাহার আদর নাই, সেখানে তিনি কেন আসিবেন ? আমাদের চেয়ে তিনি কিসে ছোটো যে, পিতা তাহাকে অপমান করিবেন ?” বলিতে বলিতে বিভা আর সামলাইতে পারিল না, তাহার মুখখানি লাল হইয়া উঠিল ও সে কঁাদিয়া ফেলিল । সুরমা বিভার মুখ বুকে রাখিয়া তাহার চোখের জল মুছাইয়া কহিল, “আচ্ছা বিভা, তুই যদি পুরুষ হইতিস তো কী করিতিস ? নিমন্ত্রণপত্র পাস নাই বলিয়া কি শ্বশুরবাড়ি যাইতিস না ?” বিভা বলিয়া উঠিল, “না, তাহা পারিতাম না, আমি যদি পুরুষ হইতাম তো এখনই চলিয়া যাইতাম ; মান অপমান কিছুই ভাবিতাম না । কিন্তু তাহা বলিয়া তাহাকে আদর করিয়া না ডাকিয়া আনিলে তিনি কেন আসিবেন ?” বিভা এত কথা কখনো কহে নাই। আজ আবেগের মাথায় অনেক কথা বলিয়াছে। এতক্ষণে একটু লজা করিতে লাগিল । মনে হইল, বড়ো অধিক কথা বলিয়া ফেলিয়াছি । আবার, যেরকম করিয়া বলিয়াছি, বড়ো লজা করিতেছে । ক্রমে তাহার মনের উত্তেজনা হ্রাস হইয়া আসিল ও মনের মধ্যে একটা গুরুভার অবসাদ আস্তে আস্তে চাপিয়া পড়িতে লাগিল। বিভা বাহুতে মুখ ঢাকিয়া সুরমার কোলে মাথা দিয়া শুইয়া পড়িল, সুরমা মাথা নত করিয়া কোমল হস্তে তাহার ঘন কেশভার পৃথক করিয়া দিতে লাগিল। এমন কতক্ষণ গেল। উভয়ের মুখে একটি কথা নাই। বিভার চোখ দিয়া এক-এক বিন্দু করিয়া জল পড়িতেছে ও সুরমা আস্তে আস্তে মুছাইয়া দিতেছে। অনেকক্ষণ বাদে যখন সন্ধ্যা হইয়া আসিল তখন বিভা ধীরে ধীরে উঠিয়া বসিল ও চোখের জল মুছিয়া ঈষৎ হাসিল । সে হাসির অর্থ, “আজি কী ছেলেমানুষই করিয়াছি।” ক্ৰমে মুখ ফিরাইয়া সরিয়া