পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (প্রথম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬৬৫

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

বউ-ঠাকুরানীর হাট V\OV) হইল না।” বলিয়া গস গস করিয়া চলিয়া গেল। একে একে ঘর খালি হইল, রামচন্দ্র রায় বিরাম পাইলেন । তখন সেই প্রৌঢ়া গৃহ হইতে বাহির হইয়া মহিষীর কক্ষে উপস্থিত হইল । সেখানে মহিষী৷ সদাসী দিগকে খাওয়াইতেছিলেন । রামমোহনও এক পার্শ্বে বসিয়া খাইতেছিল। সেই প্রৌঢ়া মহিষীর কাছে আসিয়া তাহাকে নিরীক্ষণ করিয়া কহিল, “এই যে নিকষা জননী ৷” শুনিবা মাত্র রামমোহন চমকিয়া উঠিল, প্রৌঢ়ার মুখের দিকে চাহিল । তৎক্ষণাৎ আহার পরিত্যাগ করিয়া শার্দলের ন্যায় লম্বফ দিয়া তাহার দুই হস্ত বজমুষ্টিতে ধরিয়া বীজস্বরে বলিয়া উঠিল, “আমি যে ঠাকুর তোমায় চিনি ৷” বলিয়া তাহার মস্তকের বস্ত্ৰ উন্মোচন করিয়া ফেলিল । আর কেহ নহে, রামাই ঠাকুব । রামমোহন ক্ৰোধে কঁাপিতে লাগিল, গাত্র হইতে চাদর খুলিয়া ফেলিল ; দুই হস্তে অবলীলাক্রমে রমাইকে আকাশে তুলিল, কহিল, “আজ আমার হাতে তোর মরণ আছে।” বলিয়া তাহাকে দুই-এক পাক আকাশে ঘূরাইল । মহিষী ছুটিয়া আসিয়া কহিলেন, “রামমোহন, তুই করিস কী ?” রামাই কাতরস্বরে কহিল, “ দোহাই বাবা, ব্ৰহ্মহত্যা করিস না ।” চারি দিক হইতে বিষম একটা গোলযোগ উঠিল । তখন রামমোহন রমাইকে ভূমিতে নামাইয়া কঁাপিতে কঁাপিতে কহিল, “হতভাগা, তোর কি আর মরিবার জায়গা ছিল না ?” রামাই কহিল, “মহারাজ আমাকে আদেশ করিয়াছেন।” রামমোহন বলিয়া উঠিল, “কঁী বলিলি, নিমকহারাম ? ফের আমন কথা বলিবি তো এই শানের পাথরে তোর মুখ ঘষিয়া দিব ।” বলিয়া তাহার গলা টিপিয়া ধরিল | রামাই আর্তনাদ করিয়া উঠিল । তখন রামমোহন খর্বকায় রমাইকে চাদর দিয়া বাধিয়া বস্তার মতন করিয়া ঝুলাইয়া অন্তঃপুর হইতে বাহির হইয়া গেল । দেখিতে দেখিতে কথাটা অনেকটা রাষ্ট্র হইয়া গিয়াছে । রাত্রি তখন দুই প্রহর অতীত হইয়া গিয়াছে । রাজার শ্যালক আসিয়া সেই রাত্রে প্রতাপাদিত্যকে সংবাদ দিলেন যে, জামাতা রামাই ভাঙকে রমণীবেশে অন্তঃপুরে লইয়া গেছেন । সেখানে সে পুররমণীদের সহিত, এমন-কি, মহিষীর সহিত বিদ্রুপ করিয়াছে । e . তখন প্রতাপাদিত্যের মূর্তি অতিশয় ভয়ংকর হইয়া উঠিল । রোয়ে তাহার সর্বাঙ্গ আলোড়িত হইয়া উঠিল । স্ফীতজটা সিংহের ন্যায় শয্যা হইতে উঠিয়া বসিলেন । কহিলেন, “লছমন সর্দারকে ডাকো ।” লছমন সর্দারকে কহিলেন, “আজ রাত্রে আমি রামচন্দ্র রায়ের ছিন্ন মণ্ড দেখিতে চাই ।” সে তৎক্ষণাৎ সেলাম করিয়া কহিল, “ যো হুকুম মহারাজ ।” তৎক্ষণাৎ তাহার শ্যালক তাহার পদতলে পড়িল, কহিল, “মহারাজ, মার্জন করুন, বিভার কথা একবার মনে করুন | আমন কাজ করিবেন না ।” প্রতাপাদিত্য পুনরায় দৃঢ়স্বরে কহিলেন, “আজ রাত্রের মধ্যেই আমি রামচন্দ্র রায়ের মুণ্ড চাই ।” তাহার শ্যালক তাহার পা জড়াইয়া ধরিয়া কহিল, “মহারাজ, আজ তাহারা অন্তঃপুরে শয়ন করিয়াছেন, মার্জনা করুন, মহারাজ, মার্জন করুন ।” তখন প্রতাপাদিত্য কিয়ৎক্ষণ স্তব্ধভাবে থাকিয়া কহিলেন, “লছমন, শুন, কাল প্ৰভাতে যখন রামচন্দ্র রায় অন্তঃপুর হইতে বাহির হইবে তখন তাহাকে বধ করিবে, তোমার উপর আদেশ রহিল ।” শ্যালক দেখিলেন, তিনি যতদূর মনে করিয়াছিলেন তাহা অপেক্ষা অনেক অধিক হইয়া গিয়াছে। তিনি সেই রাত্রে চুপি চুপি আসিয়া বিভীর শয়নকক্ষের দ্বারে আঘাত করিলেন । তখন দূর হইতে দুই প্রহরের নহবত বাজিতেছে। নিস্তব্ধ রাত্রে সেই নহবতের শব্দ জ্যোৎস্নার সহিত দক্ষিনা বাতাসের সহিত মিশিয়া ঘুমন্ত প্ৰাণের মধ্যে স্বপ্ন সৃষ্টি করিতেছে । বিভার শয়নকক্ষের মুক্ত বাতায়ন ভেদ করিয়া জ্যোৎস্নার আলো বিছানায় আসিয়া পড়িয়ছে, রামচন্দ্র রায় নিদ্রায় মগ্ন । বিভা উঠিয়া বসিয়া চুপ করিয়া গালে হাত দিয়া ভাবিতেছে। জ্যোৎস্নার দিকে চাহিয়া তাহার চোখ দিয়া দুই-এক বিন্দু অশ্রু ঝরিয়া পড়িতেছিল। বুঝি যেমনটি কল্পনা করিয়াছিল ঠিক তেমনটি হয় নাই । তাহার প্রাণের মধ্যে কঁদিতেছিল । এতদিন যাহার জন্য অপেক্ষা করিয়াছিল, সে দিন তো আজ আসিয়াছে ।