পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (প্রথম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬৬৮

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

S)V রবীন্দ্ৰ-রচনাবলী তৎক্ষণাৎ বসন্ত রায়ের গান বন্ধ হইয়া গেল । ত্ৰস্তভাবে উঠিয়া উদয়াদিত্যের কাছে আসিয়া শশব্যাস্তে জিজ্ঞাসা করিলেন, “আঁ্যা ! সে কী দাদা । কী হইয়াছে। কিসের বিপদ ।” উদয়াদিত্য সমস্ত বলিলেন । বসন্ত রায় শয্যায় বসিয়া পড়িলেন । উদয়াদিত্যের মুখের দিকে চাহিয়া ঘাড় নাড়িয়া কহিলেন, “না দাদা, না, এ কি কখনো হয় ? এ কি কখনো সম্ভব ?” উদয়াদিত্য কহিলেন, “আর সময় নাই, একবার পিতার কাছে যাও ।” বসন্ত রায় উঠিলেন, চলিলেন, যাইতে যাইতে কতবার জিজ্ঞাসা করিলেন, “দাদা, এ কি কখনো হয় ? এ কি কখনো সম্ভব ?” প্রতাপাদিত্যের গৃহে প্ৰবেশ করিয়াই জিজ্ঞাসা করিলেন, “বাবা প্ৰতাপ, এ কি কখনো সম্ভব ?” প্রতাপাদিত্য এখনো শয়নকক্ষে যান নাই— তিনি তাহার মন্ত্ৰগৃহে বসিয়া আছেন । একবার এক মুহুর্তের জন্য মনে হইয়াছিল। লছমন সর্দারকে ফিরিয়া ডাকিবেন । কিন্তু সে সংকল্প তৎক্ষণাৎ মন হইতে দূর হইয়া গেল। প্রতাপাদিতা কখনাে দুইবার আদেশ করেন ? যে মুখে আদেশ দেওয়া সেই মুখে আদেশ ফিরাইয়া লওয়া ? আদেশ লইয়া ছেলেখেলা করা তাহার কার্য নহে। কিন্তু বিভা ? বিভা বিধবা হইবে । রামচন্দ্র রায় যদি স্বেচ্ছাপূর্বক অগ্নিতে ঝাপ দিত, তাহা হইলেও তো বিভা বিধবা হইত। রামচন্দ্র রায় প্রতাপাদিত্য রায়ের রোষাগ্নিতে স্বেচ্ছাপূর্বক ঝাপ দিয়াছে, তাহার অনিবার্য ফলস্বরূপ বিভা বিধবা হইবে । ইহাতে প্রতাপাদিতোর কী হাত আছে । কিন্তু এত কথাও তাহার মনে হয় নাই । মাঝে মাঝে যখনই সমস্ত ঘটনাটা উজ্জ্বলরাপে তাহার মনে জাগিয়া উঠিতেছে তখনই তিনি একেবারে অধীর হইয়া উঠিতেছেন, ভাবিতেছেন, রাত কখন পোহাইবে ? ঠিক এমন সময় বৃদ্ধ বসন্ত রায় ব্যস্তসমস্ত হইয়া গৃহে প্ৰবেশ করিলেন ও আকুল ভাবে প্রতাপাদিত্যের দুই হাত ধরিয়া কহিলেন, “বাবা প্ৰতাপ, ইহা কি কখনো সম্ভব ?” প্রতাপাদিত একেবারে জুলিয়া উঠিয়া বলিলেন, “কোন সম্ভব নয় ?” বসন্ত রায় কহিলেন, “ ছেলেমানুষ, অপরিণামদর্শী, সে কি তোমার ক্ৰোধের যোগ্য পাত্ৰ ?” প্রতাপাদিত্য বলিয়া উঠিলেন, “ ছেলেমানুষ ! আগুনে হাত দিলে হাত পুড়িয়া যায়, ইহা বুঝিবার বয়স তাহার হয় নাই ! ছেলেমানুষ ! কোথাকার একটা লক্ষ্মীছাড়া নির্বোিধ মুখ ব্ৰাহ্মণ, নিবোধের কাছে দাত দেখাইয়া যে রোজগার করিয়া খায়, তাহাকে স্ত্রীলোক সাজাইয়া আমার মহিষীর সঙ্গে বিদ্রুপ করিবার জন্য আনিয়াছে— এতটা বুদ্ধি যাহার জোগাইতে পারে, তাহার ফল কী হইতে পারে, সে বুদ্ধিটা আর তাহার মাথায় জোগাইল না ! দুঃখ এই বুদ্ধিটা যখন মাথায় জোগাইবে, তখন তাহার মাথাও তাহার শরীরে থাকিবে না ।” যতই বলিতে লাগিলেন, তাহার শরীর আরো কাপিতে লাগিল, তাহার প্রতিজ্ঞা আরো দৃঢ় হইতে লাগিল, তাহার অধীরতা আরো বাড়িয়া উঠিল । বসন্ত রায় মাথা নাডিয়া কহিলেন, “আহা সে ছেলেমানুষ । সে কিছুই বুঝে না ।” প্রতাপাদিত্যের অসহ্য হইয়া উঠিল, তিনি বলিলেন, “দেখো পিতৃব্যঠাকুর, যশোহরের রায়-বংশের কিসে মান-অপমান হয় সে জ্ঞান যদি তোমার থাকিবে, তবে কি ঐ পাকা চুলের উপর মোগল বাদশাহের শিরোপা জড়াইয়া বেড়াইতে পার । বাদশাহের প্রসাদগবে তুমি মাথা তুলিয়া বেড়াইতেছ। বলিয়া প্রতাপাদিত্যের মাথা একেবারে নত হইয়া পড়িয়াছে। যবন-চরণের মৃত্তিকা তুমি কপালে ফোটা করিয়া পরিয়া থাকে । তোমার ঐ যবনের পদধূলিময় অকিঞ্চিৎকর মাথাটা ধূলিতে লুটাইবার সাধ ছিল, বিধাতার বিড়ম্বনায় তাহাতে বাধা পড়িল । এই তোমাকে স্পষ্টই বলিলাম। তুমি বলিয়াই বুঝিলে না, আজ রায়-বংশের কতবড়ো অপমান হইয়াছে, তুমি বলিয়াই আজ রায়-বংশের অপমানকারীর জন্য মার্জনা ভিক্ষা করিতে আসিয়াছ ।” বসন্ত, রায় তখন ধীরে ধীরে বলিলেন, “প্ৰতাপ, আমি বুঝিয়াছি, তুমি যখন একবার ছুরি তোল, তখন সে ছুরি একজনের উপর পাড়িতেই চায় । আমি তাহার লক্ষ্য হইতে সরিয়া পড়িলাম বলিয়া আর-একজন তাহার লক্ষ্য হইয়াছে । ভালো প্ৰতাপ, তোমার মনে যদি দয়া না থাকে, তোমার ক্ষুধিত ক্ৰোধ একজনকে যদি গ্ৰাস করিতেই চায়, তবে আমাকেই করুক। এই তোমার খুড়ার মাথা (বলিয়া