পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (প্রথম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬৭৫

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

বউ-ঠাকুরানীর হাট \ტ8\9 জন্মিল ; তাহার প্রধান কারণ, উদয়াদিত্যের প্রতি সে ভারি ক্রুদ্ধ হইয়া উঠিয়াছিল। ভাগবত কহিল, “এমন কথা আমাকে আদেশ করিবেন না, ইহাতে আমার অধৰ্ম হইবে ।” বসন্ত রায় তাহার কাধে হাত দিয়া কহিলেন, “ভাগবত, আমার কথা শুন ; ইহাতে কোনো অধৰ্ম নাই। সাধু লোকের প্রাণ বঁাচাইতে মিথ্যা কথা বলিতে যদি কোনো অধৰ্ম থাকিবে, তবে আমি কেন তোমাকে এমন অনুরোধ করিব ?” বসন্ত রায় তাহার কাধে হাত দিয়া পিঠে হাত দিয়া বার বার করিয়া বুঝাইতে চেষ্টা করিলেন, ইহাতে কোনাে অধৰ্ম নাই। কিন্তু লোকের যখন ধৰ্মজ্ঞান সহসা বিশেষ প্রবল হইয়া উঠে, তখন কোনো যুক্তিই তাহার কাছে খাটে না । সে কহিল, “না মহারাজ, মনিবের কাছে মিথ্যা কথা বলিব কী করিয়া ।” বসন্ত রায় বিষম অস্থির হইয়া উঠিলেন । ব্যাকুলভাবে কহিলেন, “ভাগবত, আমার কথা শুন, আমি তোমাকে বুঝাইয়া বলি, এ মিথ্যা কথায় কোনো পাপ নাই। দেখো বাপু, আমি তোমাকে পরে খুব খুশি করিব, তুমি আমার কথা রাখো । এই লও আমার কাছে যাহা আছে, এই দিলাম।” ভাগবত তৎক্ষণাৎ হাত বাড়াইল ও সেই টাকাগুলা মুহুর্তের মধ্যে তাহার ট্যাকে আশ্রয় লাভ করিল । বসন্ত রায় কিয়ৎপরিমাণে নিশ্চিন্ত হইয়া ফিরিয়া গেলেন । প্রতাপাদিত্যের নিকট প্রহরীদ্বয়ের ডাক পড়িয়াছে। মন্ত্রী তাহাদিগকে সঙ্গে করিয়া লইয়া গেলেন । প্রতাপাদিত্য তখন তাহার উচ্ছসিত ক্ৰোধ দমন করিয়া স্থির গভীর ভাবে বসিয়া আছেন । প্রত্যেক কথা ধীরে ধীরে স্পষ্টরূপে উচ্চারণ করিয়া কহিলেন, “কাল রাত্রে অন্তঃপুরের দ্বার খোলা হইল কী করিয়া ?” সীতারামের প্রাণ কঁপিয়া উঠিল, সে জোড়হস্তে কহিল, “ দোহাই মহারাজ, আমার কোনো দোষ নাই ।” মহারাজ ভুকুঞ্চিত করিয়া কহিলেন, “সে কথা তোকে কে জিজ্ঞাসা করিতেছে ?” সীতারাম তাড়াতাড়ি কহিল, “আজ্ঞা না, বলি মহারাজ, যুবরাজ- যুবরাজ আমাকে বলপূর্বক বাধিয়া অন্তঃপুর হইতে বাহির হইয়াছিলেন।” যুবরাজের নাম তাহার মুখ দিয়া কেমন হঠাৎ বাহির হইয়া গেল । ঐ নামটা কোনোমতে করিবে না বলিয়া সে সর্বাপেক্ষা অধিক ভাবিয়াছিল, এই নিমিত্ত গোলমালে ঐ নামটাই সর্বাগ্রে তাহার মুখাগ্রে উপস্থিত হইল। একবার যখন বাহির হইল। তখন আর রক্ষা নাই । এমন সময় বসন্ত রায় শুনিলেন, প্রহরীদের ডাক পড়িয়াছে। তিনি ব্যস্তসমস্ত হইয়া প্রতাপাদিত্যের কক্ষে গিয়া উপস্থিত হইলেন । তখন সীতারাম কহিতেছে, “যুবরাজকে আমি নিষেধ করিলাম, তিনি শুনিলেন না ।” বসন্ত রায় তাড়াতাড়ি বলিয়া উঠিলেন, “হা হা সীতারাম, কী কহিলি ? অধৰ্ম করিস নে, সীতারাম, ভগবান তোর 'পরে সন্তুষ্ট হইবেন । উদয়াদিত্যের ইহাতে কোনো দোষ নাই ।” সীতারাম তাড়াতাড়ি বলিয়া ফেলিল, “আজ্ঞা না, যুবরাজের কোনো দোষ নাই ।” প্রতাপাদিত্য দৃঢ়স্বরে কহিলেন, “তবে তোর দোষ ?” সীতারাম কহিল, “আজ্ঞা না ।” “তবে কার দোষ ?” “আজ্ঞা মহারাজ-” ভাগবতকে যখন জিজ্ঞাসা করা হইল, তখন সে সমস্ত কথা ঠিক করিয়া কহিল, কেবল সে যে ঘুমাইয়া পড়িয়ছিল সেইটে গোপন করিল। বৃদ্ধ বসন্ত রায় চারি দিক ভাবিয়া কোনো উপায় দেখিলেন না । তিনি চােখ বুজিয়া মনে মনে “দুৰ্গা” “দুৰ্গা” কহিলেন । প্রহরীদ্বয়কে তৎক্ষণাৎ কর্মচ্যুত করা হইল । তাহাদের অপরাধ এই যে, তাহাদের যদি বলপূর্বক বাধিতে পারা যায়। তবে তাহারা প্রহরী-বৃত্তি করিতে আসিয়াছে কী বলিয়া ? এই অপরাধের জন্য তাহদের প্রতি কশাঘাতের আদেশ হইল । তখন প্রতাপাদিত্য বসন্ত রায়ের মুখের দিকে চাহিয়া বজগভীর স্বরে কহিলেন, “উদয়াদিত্যের এ অপরাধের মার্জনা নাই!” এমনি ভাবে বলিলেন যেন উদয়াদিত্যের সে অপরাধ বসন্ত রায়েরই । যেন